সিলেটের প্রভাবশালী বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি চিরকালীন রহস্য হয়ে রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রকাশিত একটি স্বীকারোক্তি এবং অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের মাধ্যমে এই গুম ও হত্যাকাণ্ডের পেছনের লোমহর্ষক ঘটনাগুলো নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাতে ইলিয়াস আলী ঢাকা থেকে বাসায় ফেরার সময় তাকে অপহরণ করা হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সূত্রমতে, র্যাব সদস্য সার্জেন্ট তাহেরুল ইসলামের স্বীকারোক্তি থেকে জানা যায়, তৎকালীন মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানের নেতৃত্বে এই অপহরণ ও হত্যাকাণ্ড ঘটে। তাহেরুল বলেন, “শেরাটন হোটেল থেকে ইলিয়াস আলীকে অনুসরণ করতে বলা হয়েছিল। বনানীর ২ নম্বর সড়কের কাছে তার গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভার আনসারসহ তাকে অপহরণ করা হয়।”
অপহরণের পরে ইলিয়াস আলীকে হত্যা করা হয় এবং তার মরদেহ যমুনা নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। তৎকালীন র্যাব কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান নিজের সহকর্মীদের সামনে বলেছিলেন, আজ বড় অপারেশনে সাকসেসফুল, শেষ করে তাকে যমুনায় ফেলে দিয়ে এসেছি।
গুম তদন্ত কমিশনের সূত্রমতে, এই গুম এবং হত্যার নির্দেশ এসেছিল খোদ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে। অনুসন্ধানে জানা যায়, শেখ হাসিনা নিজেই ডিজিএফআই এবং অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ইলিয়াস আলীকে গুম করার নির্দেশ দেন।
অভিযোগ রয়েছে, শেখ হাসিনা পরবর্তী সময়ে ইলিয়াস আলীর স্ত্রীকে ডেকে এনে নাটক করেছিলেন। পুরাতন শাড়ি পরে তিনি ইলিয়াস আলীর স্ত্রী ও কন্যাকে সান্ত্বনা দেন এবং দাবি করেন, বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণেই এই অপহরণ ঘটেছে।
র্যাবের কিলিং স্কোয়াডের নেতৃত্বে থাকা মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান এবং তার সহযোগীরা এই ধরনের আরও অনেক হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তথ্য অনুসারে, স্কোয়াডের এক সদস্য একদিনে ১১ জন এবং আরেক সদস্য ১৩ জনকে খুন করেন। এই দল ইলিয়াস আলীর গুম ও হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
ইলিয়াস আলীর অপহরণে জড়িত সেনাসদস্যদের মধ্যে ওয়ারেন্ট অফিসার জিয়া এবং ইমরুলের নাম উঠে এসেছে। গুম তদন্ত কমিশনের সুপারিশে সেনাবাহিনী এই দুই সদস্যকে ক্লোজড এবং অন্তরীণ করেছে। তদন্ত সূত্রে জানা যায়, এই সেনাসদস্যরা জিয়াউল আহসানের নির্দেশ বাস্তবায়নে কাজ করতেন এবং প্রতিটি মিশন সফল করার জন্য নির্দেশনা মেনে চলতেন।
শেখ হাসিনার পতনের পর যখন তিনি দেশ ছেড়ে পালান, তখন গোপন বন্দিশালা ‘আয়নাঘর’ থেকে অনেক বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়। তবে ইলিয়াস আলীকে সেখানে পাওয়া যায়নি। এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে ইলিয়াস আলীকে জীবিত পাওয়া গেছে। তবে পরবর্তীতে নিশ্চিত হওয়া যায়, তাকে হত্যা করে যমুনা নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
গুম তদন্ত কমিশন এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের যৌথ তদন্তে উঠে এসেছে, ইলিয়াস আলীর হত্যাকাণ্ড একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ফল। এটি শুধুমাত্র একটি ব্যক্তির অপহরণ ও হত্যা নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ভয়াবহ দমন-পীড়নের একটি উদাহরণ।
ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটি বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে এক চিরস্থায়ী বেদনা এবং প্রশ্ন রেখে গেছে। এই চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের সত্যতা এবং এর পেছনের নৃশংস পরিকল্পনার বিষয়টি দেশবাসীর মনে দাগ কেটে গেছে। ভবিষ্যতে এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে, সেই আশায় দেশবাসী সতর্ক দৃষ্টি রাখছে।