বাবার মৃত্যুর পর নানা আলোচনা-সমালোচনার এক পর্যায়ে সন্তান হয়ে নিজের মাকে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন জানিয়ে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস শেয়ার করেন জান্নাতুল ফেরদৌস লিজা নাম এক তরুণী। এর পর থেকেই রীতিমতো শুরু হয়ে ব্যাপক শোরগোল।
এদিকে “মায়ের বিয়ে” নিয়ে ফেসবুকে দেওয়া ভাইরাল হওয়া স্ট্যাটাস প্রসঙ্গে সোমবার (৩ অক্টোবর) বিকেলে সংবাদ মাধ্যমে এসব কথা বলেন জান্নাতুল ফেরদৌস লিজা।
জান্নাতুল ফেরদৌস লিজা বলেন, “কারো প্রশংসা বা সমালোচনায় কান দিতে নয়, আমি আর আমার বোন মাকে ভালো রাখতে চাই। আমাদের দুই বোনকে যেভাবে রেখেছেন।”
শুক্রবার ফেসবুকে তার দেওয়া “আজ আমাদের মায়ের বিয়ে” নিয়ে একটি স্ট্যাটাস ইতোমধ্যেই ভাইরাল হয়েছ। মেয়ের এমন উদ্যোগের প্রশংসা করছেন অনেকেই।
জানা যায়, ব্যবসায়িক ক্ষতি, আর্থিক সংকট এবং স্বজনদের আনা ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে স্বজনদের দ্বারা অপমানিত হয়ে ২০১৭ সালের আগস্টে রাজধানীর মিরপুরে নিজ কারখানায় ‘আ””ত্ম’হ””ত্যা” করেন তাদের বাবা রুহুল আমিন। .
লিজা বলেন, “তখন মিরপুরে বাড়ির নিচে আমাদের সেলাইয়ের কারখানা ছিল। মা মেয়েদের কাপড় সেলাই করতেন আর বাবা ছেলেদের কাপড় সেলাই করতেন। ২০১৬ সালে আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে সুদে ৬ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে বাবা সেলাইয়ের ব্যবসায়টি বড় করা চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যবসায় লোকসানের কারণে আমরা আর্থিক সংকটে পড়ে যাই।আমি অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২য় সেমিস্টারে এবং আমার বোন ৮ম শ্রেণীতে পড়ে। আমার পড়াশুনা প্রায় শেষ হতে চলেছে। ,ঋণের সুদ আসলে বেড়েই চলেছে।একপর্যায়ে আত্মীয়রা চাপ দিতে থাকে।ঋণদাতা এক আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়ার পর বাবাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন।অপমান সইতে না পেরে আববু মৃত্যুর পথ বেছে নেন।
তিনি বলেন, তখন থেকেই মা নাদিরা বেগম ও তার দুই মেয়ের নতুন সংগ্রাম শুরু হয়। ফি দিতে না পারায় তাদের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় ৮ লাখ টাকা ঋণের বোঝা নিয়ে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষকতা ও কাজ শুরু করেন জান্নাতুল ফেরদৌস লিজা। মারিয়াম জ্বীমও টিউশনি শুরু করেন সংসারের খরচ যোগাতে।
লিজা বর্তমানে একটি অনলাইন ব্যবসা পরিচালনা করছেন। এছাড়া অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ সেমিস্টারে পড়ছে। তার ছোট বোন মারিয়াম জ্বীম মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
একা থাকা যেন শাস্তি:
জান্নাতুল ফেরদৌস লিজা তার ফেসবুক স্টাটাসে বলেন, “একা বেঁচে থাকাটা এক প্রকার শাস্তি। আর এমন শাস্তি পাওয়ার মত কোনো অন্যায় তো সে করেননি! তাহলে কেনো শেষ সময়টা সে একা থাকবে? কেনো তার পাশে কথা বলার একটা মানুষ থাকবে না? তার স্বামী মারা গেছেন বলে? তার প্রচুর অর্থ নেই বলে? তার বয়স হয়েছে বলে? আমাদের এই মুখপোড়া সমাজের জন্য? নাকি তার ছেলে সন্তান নাই এটাই তার সবচেয়ে বড় অপরাধ? আমরা হয়তো অর্থনৈতিক সাপোর্ট তাকে দিতে পেরেছি, কিন্তু মানুষের অভাব কখনও টাকা দিয়ে মেটানো সম্ভব না। আর্থিক সচ্ছলতা অবশ্যই জরুরি, এবং একইসাথে একটা নিজের মানুষও খুব জরুরি।”
তিনি লিখেন, “আসলে, পাছে লোকে কিছু বলবে এই ভয়গুলা আমার সবসময়ই একটু কম ছিল! কারণ ভালো অথবা খারাপ কোনোটাতেই পাছে কথা বলা লোকের অভাব হয়না। এই দেশ হিপোক্রেটের দেশ! আমার ঘোর বিপদের সময়ও সাহায্য করার চেয়ে পাছে কথা বলার লোকের সংখ্যা দিগুণ দেখেছি আমি! এখনও বন্ধ হয়নি। তাই এদের ভয়ে আমার কোনোকিছুই কখনও আটকে থাকেনি, থাকবেও না। নিম্ন মানসিকতার সমাজ এবং মানুষদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আজ আমরা আমার মায়ের বিয়ে দিয়েছি এবং সেটা সবাইকে এই পোস্টের মাধ্যমে একযোগে জানিয়ে দিলাম। আলহামদুলিল্লাহ ।”
তবে মায়ের বিয়ের দেয়া হলেও এখনো থেমে তাদের নিয়ে সমালোচনা। এখনো অনেকেই অনেক কথা বলছেন। তবে নিন্দুকের এ সমালোচনার কান দিচ্ছেন না তারা। চলছেন নিজের মতো করেই।