সিলেটে বন্যার পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এখন প্রর্যন্ত পানিতে আটকে আছে বহু মানুষ। তাদের উদ্ধারে গত শুক্রবার থেকে সেনা সদস্যরা বিভিন্ন উপজেলায় উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেছে। শনিবার থেকে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি নৌবাহিনীর সদস্যরাও উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়েছেন বলে জানিয়েছিলেন সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মুজিবুর রহমান দেশের একটি জনপ্রিউ গনমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
মাত্র দেড় থেকে দুই মাস আগের কথা। ভাগ চাষের (বর্গা জমি) জমির বোরো ধান তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ফখরুল। তবে ঘরে তুলতে পারেননি ফসল। সেই ধকল কাটিয়ে উঠতে না–উঠতেই এই দফা বন্যায় এক রাতেই প্রয়াত হয়েছে প্রায় দেড় লাখ টাকা দামের তিনটি গরু। বন্যার পানিতে দাঁড়িয়ে সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার বাওনপুরের বাসিন্দা ফখরুল মিয়া বলছিলেন এই দুঃখের কথা। বললেন, গরুর ওপরেই আমার সংসার চলে (গরু লালন–পালন করেই সংসার চলে)। কিতা করমু (কি করব), তকদির মন্দ। বড় অসহায় অইয়া পড়লাম (হয়ে গেলাম)। গতকাল শনিবার বিকেলে বিশ্বনাথ সড়কে আরও অনেকের সঙ্গে জাল দিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা করছিলেন ফখরুল। ৫০ পেরোনো একজন মানুষ তিনি। কিছুক্ষণ পরপর জাল তুলছেন। কিছু ছোট মাছ জালে উঠছে। তা ধরে ঝোলায় রাখছেন। অনেকক্ষণ পানিতে দাঁড়ানো, বৃষ্টি ও বাতাসে ঠান্ডা লেগে কাঁপছিলেন তিনি।
ফখরুল মিয়া বললেন, গত শুক্রবার থেকে পানি বাড়ছে। এই দিনই বাড়িতে বন্যার পানি উঠে যায়। তাঁর ১৪টি গরু। চারদিকে পানি থাকায় গরুগুলো সরানোর কোনো সুযোগ পাননি। গরুগুলোও পানিতে ছিল। শুক্রবার রাতেই তিনটি গরু প্রয়াত হয়েছে। তাঁর ধারণা, ঠান্ডা লেগেই গরুগুলোর এই অবস্থা হয়েছে। গরুর শোকে মন ভেঙে যায় ফখরুলের। প্রয়াত গরুগুলো পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছেন। তিনটি গরুর মূল্য আনুমানিক দেড় লাখ টাকা। এখন ১১টা গরু আছে। এগুলো নিয়েও বিপন্ন অবস্থা। ফখরুল আরও বলেন, চাইছিলাম ঈদে গরু বিক্রি করি বড় মেয়ের বিয়া দিমু (বিয়ে দিব)। কিন্তু কিচ্ছু করার নাই, তকদির মন্দ। গরু এই পরিনতি হওয়ায় মেয়েরা কান্নাকাটি করছে, কইছি, কান্দিও না। তকদিরে যা আছে, তাই অইব। প্রায় ১০-১২ বছর ধরে ফখরুল গরু লালন–পালন করেন। গরু বিক্রি করে যে আয় হয়, তাই দিয়েই সংসার চালান, তিন মেয়ে তাঁর। একজন স্নাতক শ্রেণিতে, একজন উচ্চমাধ্যমিকে এবং একজন এবারের মাধ্যমিকের পরীক্ষার্থী।
ফখরুল বলেন, এ রকম পানি আর কোনো দিন দেখছি না। ঘরও পানি উঠি গেছে। চেষ্টা করছিলাম থাকার। পারতাম নায় (পারব না)। আইজ (শনিবার রাতে) হুরুত্বারে (সন্তানদের) আত্মীয় বাড়ি পাঠাই দিমু, গরু আছে, নিজে থাকমু (থাকবো), পেনাটেনা (কচুরিপানা), খড়-পানি গরুরে খাওয়াইমু (খাওয়াব)। টিকানির চেষ্টা করা আরকি। ২০০৪ সালেও পানি এসেছিল বললেন ফখরুল। কিন্তু সেবার পানি ছিল বাড়ির নিচে। তাই তাঁর কোনো সমস্যা হয়নি। দেড় থেকে দুই মাস আগের বন্যায় ধান নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এখন চাল কিনে খেতে হচ্ছে ফখরুল ও তাঁর পরিবারকে। পবিত্র ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে গরু বিক্রি করে লাভের যে আশা দেখেছিলেন, এবার তাতেও ভাটা পড়ল। ফখরুল মিয়ার প্রতিবেশী আশিক আলি বলেন, ঘরর মাঝে উরাত (ঊরুসমান) পানি। ঘর ছাড়িয়া আমি আইজ (শনিবার) আশ্রয়কেন্দ্রে উঠছি। কিচ্ছু হরাইবার (সরানোর) সিস্টেম নাই। হরাইয়া নিতাম (সরিয়ে নিব) যে জাগার তো দরকার। খালি রাজাই-বেড (লেপ-তোশক) হরাইছি। আগেরবার ধান আর এই গরু গরু, আমিতো শেষ।
উল্লেখ্য, স্থানীয় জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, নৌবাহিনীর ৩৫ সদস্যের একটি ডুবুরি দল উদ্ধার কার্যক্রমের উদ্দেশ্যে কাজ শুরু করে চলেছে। ৬০ সদস্য বিশিষ্ট আরেকটি দল সিলেটে পৌঁছাবে বলেও জানিয়েছেন। দুটি কোস্টগার্ড ক্রুজও সেখানে উদ্ধার তৎপরতার কাজে নিয়োজিত থাকবে। একজন সুনামগঞ্জে এবং একজন সিলেটে উদ্ধার কাজে নিয়োজিত থাকবেন। এছাড়া বিমান বাহিনীর দুটি হেলিকপ্টার উদ্ধার কাজে নিয়োজিত থাকবে। সেনা সদস্যরা রেসকিউ বোট দিয়ে গ্রামে জলাবদ্ধ মানুষকে উদ্ধার করছে।