দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে আওয়ামী লীগ যে কৌশল নিয়েছে তা সফল হয়েছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদে পাঁচটি রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা সদস্য হচ্ছেন। আওয়ামী লীগের ২২২ জন, জাতীয় পার্টির ১১ জন, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও কল্যাণ পার্টির একজন করে এবং স্বতন্ত্র ৬২ জন বিজয়ী প্রার্থী সংসদ সদস্য হচ্ছেন।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ভোটে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা পেয়েছেন ৭৪.৫৮ শতাংশ ভোট, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পেয়েছেন ২০.৭৪ শতাংশ, জাতীয় পার্টি ৩.৬৮ শতাংশ ও বাকি তিন রাজনৈতিক দল পেয়েছে ১ শতাংশ ভোট।
জাতীয় পার্টি যে ১১টি আসনে জিতেছিল তার সবই আওয়ামী লীগের ছাড় পাওয়া ছিল। ছাড়ের বাইরে একটি আসনেও জয় পায়নি জাতীয় পার্টি। নৌকা প্রতীকে লড়েছে জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টি। কল্যাণ পার্টির আসনেও ছিল ছাড়।
নির্বাচন সফল করার পেছনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার অন্যতম কৌশল ছিল দলীয় প্রার্থীর বাইরে স্বতন্ত্র হিসেবে তার নিজ দলের নেতাদের সঙ্গে খোলামেলা প্রতিযোগিতা।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার কৌশলের কারণে দলের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী প্রার্থীও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে পরাজিত হয়েছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য বলেন, স্বতন্ত্র নির্বাচিত নেতাদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের দায়িত্বশীল নেতা। তৃণমূল পর্যায়ে দলীয় কোন্দল থাকবে বলে আমি মনে করি না।
আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোটের শরিকরাও অনেক জায়গায় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে হেরেছে। এমনকি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেওয়া কয়েকটি আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হারতে হয়েছে লাঙ্গলকে। ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগের শরিক ও জাতীয় পার্টি স্বতন্ত্র কৌশলে পরাজিত হয়।
হবিগঞ্জ-৪ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও যুবলীগ নেতা সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনের কাছে দেড় লাখ ৫১ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী।
ঢাকা-১৯ আসনে হেরেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান। এ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আশুলিয়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম জয়ী হয়েছেন।
যশোর-৫ আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী ইয়াকুব আলীর কাছে পরাজিত হয়েছেন পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য।
ফরিদপুর-৪ আসনে আওয়ামী লীগের আরেক জনপ্রিয় স্বতন্ত্র প্রার্থী মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন তৃতীয়বারের মতো দলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান কাজী জাফর উল্লাহকে পরাজিত করেছেন।
আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক ও নেত্রকোনা-৩ আসনে দলীয় মনোনীত প্রার্থী অসীম কুমার উকিল স্বতন্ত্র প্রার্থী ইফতেখার উদ্দিন তালুকদার পিন্টুর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও প্রায় দুই হাজার ভোটে পরাজিত হন। মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনে আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক ও দলীয় মনোনীত প্রার্থী মৃণাল কান্তি দাস স্বতন্ত্র ও মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার সাবেক মেয়র মোহাম্মদ ফয়সালের কাছে পরাজিত হয়েছেন।
কুষ্টিয়া-২ আসনে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু। ইনু হেরেছেন সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কামারুল আরেফিনের কাছে।
মাদারীপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ। তিনি কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি স্বতন্ত্র প্রার্থী তাহমিনার কাছে হেরে যান।
তিন জোটের শরিকদের মধ্যে ছয়টি আসন বণ্টন করে আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে বরিশাল-২ আসনে জয়ী হয়েছেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এবং বগুড়া-৪ আসনে জাসদের রেজাউল করিম তানসেন।
পিরোজপুর-২ আসনে জাতীয় পার্টির (জেপি-মঞ্জু) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু তার এক সময়ের এপিএস মহিউদ্দিন মহারাজের কাছে পরাজিত হয়েছেন।
ঢাকা-১৮ আসনে জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের স্ত্রী শরিফা কাদেরের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী থাকবে না বলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি হয় জাপা। কিন্তু ভোটের ফলাফলে মাত্র ৬ হাজার ৪২৯ ভোট পেয়ে শেরেফা কাদের এখন জামানত হারাতে যাচ্ছেন। এ আসনে জয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী খসরু চৌধুরী।
তৃতীয় হয়েছেন বরগুনা-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও তিনবারের সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু। বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম সারোয়ার টুকু বিজয়ী হয়েছেন।
গাজীপুর-৫ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ও মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি প্রায় ১২ হাজার ভোটের ব্যবধানে হেরেছেন দলীয় নেতা ও ঢাকসুর সাবেক ভিপি আকতারুজ্জামানের কাছে।
ফরিদপুর-৩ আসনে স্বতন্ত্র ও আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। নির্বাচনের পর স্বতন্ত্র প্রার্থী একে আজাদের কাছে পরাজিত হন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামীম হক। মানিকগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের তিনবারের সংসদ সদস্য মমতাজ বেগমকে পরাজিত করেছেন দলটির স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ান জাহিদ আহমেদ।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবউল আলম হানিফ বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জয়ী করা আওয়ামী লীগের কৌশল নয়। আওয়ামী লীগের লক্ষ্য ছিল নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করা।
সর্বোচ্চ ভোট শেখ সেলিমের, কম কামাল মজুমদারের
নির্বাচন কমিশনের তথ্য মতে, এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গড় ভোট পড়েছে ৪১.৮০ শতাংশ। দেশের ২৯৮টি সংসদীয় আসনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে গোপালগঞ্জ-৩ আসনে। এ আসনে ভোট পড়েছে ৮৭.২৪ শতাংশ। অন্যদিকে সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে ঢাকা-১৫ আসনে। এ আসনে ভোটের হার ১৩.০৪ শতাংশ।
নির্বাচন কমিশনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গোপালগঞ্জ-৩ আসনে দুই লাখ দুই হাজার ৯৭ ভোটের মধ্যে ভোট পড়েছে দুই লাখ ৫৩ হাজার ২৪৭টি। ভোটের হার ৮৭.২৪ তাংশ। এ আসনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই লাখ ৪৯ হাজার ৯৬২ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। তাঁর নিকটতম বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির এম নিজাম উদ্দিন লস্কর পেয়েছেন ৪৬৯ ভোট।
ঢাকা-১৫ আসনে তিন লাখ ৪৪ হাজার ৫০৭ ভোটের মধ্যে পড়েছে ৪৪ হাজার ৯৩৬ ভোট। ভোটের হার ১৩.০৪ শতাংশ। এ আসনে আওয়ামী লীগের কামাল আহমেদ মজুমদার নৌকা প্রতীকে ভোট পেয়েছেন ৩৯ হাজার ৬৩২টি।
নির্বাচনে ২৯৮টি আসনের মধ্যে ৮০টিতে ভোট পড়েছে ৫০ শতাংশের বেশি। রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে ঢাকা-১২ আসনে। এ আসনে ভোট পড়েছে ৩০.৫ শতাংশ। এ আসন থেকে বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বিজয়ী হয়েছেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গোপালগঞ্জ-২ আসনের শেখ ফজলুল করিম সেলিম সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি পেয়েছেন দুই লাখ ৯৫ হাজার ২৯১ ভোট। তার নিকটতম জাতীয় পার্টির কাজী শাহীন পেয়েছেন ১ হাজার ৫১৪ ভোট। দুই প্রার্থীর ভোটের পার্থক্য দুই লাখ ৯৩ হাজার ৭৭৭।
ঢাকা-৪ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সবচেয়ে কম ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন আওলাদ হোসেন। তিনি পেয়েছেন ২৪ হাজার ৭৭৫ ভোট।