বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর একটানা ১৩ বছর দেশ পরিচালনা করছে। এই ১৩ বছরে দলটি রাজনীতিতে থেকে অনেকটা একচ্ছত্র এবং নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে। সংসদে বিরোধী দল থাকলেও সেটা অনেকটা গৃহপালিত বলা যায়। দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপি রাজপথে নামবে নামবে বললেও রাজপথে নেই।
শুধুমাত্র বিএনপি নয় রাজনীতি বলে যে শব্দটি সেটাই এখন রাজপথ থেকে বিলীন হয়ে গেছে। কিন্তু প্রকৃতিকে উপেক্ষা করা যায় না একটি বিষয়ে আর সেটা হলো প্রকৃতি কোনো শূন্যতাকে পছন্দ করেনা। তবে রাজনীতিতে বিরোধী দলের যে শূন্যতা রয়েছে সেটা অনেকটা পুরন করার জন্য বেশ কৌশলী পদক্ষেপ নিয়ে মাঠে নেমেছে ক্ষমতাসীন দল। বর্তমান সময়ে আমরা একটু নজর দিলেই দেখতে পারবো, আ.লীগের প্রতিপক্ষ হিসেবে এখন আ.লীগ, সবখানে এটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক। রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত রাখার জন্য আওয়ামীলীগ আওয়ামীলীগের সাথে এক ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বীতার খেলায় মেতে উঠেছে। আর রাজনীতির মাঠ সরগরম রাখার জন্য নিজেদের নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়টির মাধ্যমে জড়িয়ে যাচ্ছে। দেশজুড়ে চলছে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন আর এই নির্বাচনে দলটি থেকে মনোয়ন একজনকে দেওয়া অন্য জন হচ্ছে বিদ্রোহী প্রার্থী। কিন্তু অন্য দলের মদ্যে কিন্তু সেটা দেখা যাচ্ছে না। নির্বাচনকে সরকারও বেশ দীর্ঘ সময় ধরে চালিয়ে যাচ্ছে।
একের পর এক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা হারছে, নৌকার জামানত বাজেয়াপ্ত হচ্ছে। এতে দুইটা ব্যাপার ঘটছে, বিএনপি অংশ না নিলেও নির্বাচন হচ্ছে বেশ জমাজমাট এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। আর নৌকার ভরাডুবিতে সরকারি দল বড় গলায় বলতে পারছে, নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে। কিন্তু এতে যে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে শক্তিদর জায়গা তৃণমূলে বিভেদের বি’ষ ঢুকে যাচ্ছে, তা নিয়ে দলটির মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না।
অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস দলটির জন্য বড় বিপ’র্যয় ডেকে আনতে পারে। বড় দলে অন্তর্দ্বন্দ্ব থাকেই। আর টানা ১৩ বছর ক্ষমতায় থাকা দলে সুবিধাবাদীদের ভিড়ও থাকে। তবে এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্বকে যতটা প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে, তা অতীতে দেখা যায়নি। আর এই প্রশ্রয়ে অন্তর্দ্বন্দ্ব যতটা সহিং’স ও প্রকাশ্য হয়ে উঠছে; তাও অতীতে দেখা যায়নি। কিন্তু দলে দলে আওয়ামী লীগের বিদ্রো’হীরা দলের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে নির্বাচনে অংশ নিলেও দলটির তাদের ব্যাপারে মুখে কঠোর হলেও বাস্তবে তা নয়। অন্তর্দ্বন্দ্বের এই ক্ষত ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ কীভাবে সামাল দেবে, সেটা দেখার অপেক্ষা করতে হবে।
তবে এই মুহূর্তে রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি আলোচনা নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। ঢাকার পাশের এই নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়েই মূল আলোচনা। তবে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব আজকের নতুন নয়, এই দ্বন্দ্ব পারিবারিক উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান আলী আহমেদ চুনকার সাথে ওসমান পরিবারের দ্বন্দ্ব সেই আদিকালের। আবার দুই পরিবারই আওয়ামী লীগের পরীক্ষিত দুর্গ।
শামীম ওসমানের দাদা এম ওসমান আলী আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। ওসমান পরিবারের নেতৃত্ব এখন শামীম ওসমানের কাঁধে। আর চুনকার ঐতিহ্য বহন করছেন তার কন্যা সেলিনা হায়াত আইভী। এই দুই পরিবারের দ্বন্দ্ব নতুন করে প্রকাশ পায় ২০১১ সালে। নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা সিটি করপোরেশনে উন্নীত হওয়ার পর প্রথম নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন শামীম ওসমান। আর নাগরিক কমিটির মনোনয়নে মাঠে নামেন আইভী। সে নির্বাচনে আইভীর কাছে শামীম ওসমান হেরে গেলে দ্বন্দ্ব নতুন রূপ পায়।
২০১৬ সালের নির্বাচনে অবশ্য আওয়ামী লীগের মনোনয়নেই মেয়র নির্বাচিত হন আইভী। এবারও দলের মনোনয়ন পেয়েছেন আইভীই। তার প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক বিএনপি নেতা এডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার। সাবেক বলছি, কারণ দলের সিদ্ধান্তের বাইরে নির্বাচনে অংশ নেয়ায় বিএনপির পদ হারিয়েছেন তৈমুর। বিএনপির পদ হারালেও আওয়ামী লীগের ওসমান অংশের সমর্থন পাচ্ছেন তৈমুর আলম খন্দকার। নারায়ণগঞ্জে লড়াইটা তাই আওয়ামী লগের সাথে আওয়ামী লীগেরই।
ওসমান পরিবারের নেতৃত্ব শামীম ওসমানের হাতে হলেও তার ভাই সেলিম ওসমান আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী জাতীয় পার্টির সাংসদ। তার আরেক ভাই প্রয়াত নাসিম ওসমানও জাতীয় পার্টির সাংসদ ছিলেন। নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী সাংসদ শামীম ওসমান বা সেলিম ওসমানের পক্ষে সরাসরি সেলিনা হায়াত আইভীর পক্ষে মাঠে নামা সম্ভব নয়। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের মানুষ জানে সরাসরি মাঠে নামার সুযোগ না থাকলেও শামীম ওসমান এবং তার ভাই সেলিম ওসমানের আশীর্বাদ স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকারের পক্ষে।
এরই মধ্যে জাতীয় পার্টির কাউন্সিলররা তৈমুরের পক্ষে মাঠে নেমেছেন। তৈমুর আলম খন্দকারের ভাই খোরশেদ আলমের বিপক্ষে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া কাউন্সিলর প্রার্থী রবিউল হোসেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাড়িয়েছেন। তাতে খোরশেদের জয় যেমন নিশ্চিত, তেমনি তিনি তার ভাইয়ের পক্ষে পুরোপুরি মাঠে থাকতে পারেন। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করায় রবিউলকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কার হলেও রবিউল শামীম ওসমানের সাথেই আছেন।
মহানগর ছাত্রলীগও আইভীর পক্ষে মাঠে নামেনি। তাই মহানগর কমিটিই বিলুপ্ত করা হয়েছে। শুধু রবিউল বা ছাত্রলীগ নয়, শামীম ওসমানের অনুসারী হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগের অংশটি নেই আইভীর পাশে। বরং তারা আইভীর ভাবমূর্তি নষ্ট করার নানারকম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত খোকন সাহা যুবলীগের এক নেতার কাছে আইভীর নির্বাচনের জন্য ৫ লাখ টাকা চাঁদা চেয়েছেন। সেই অডিও ফাঁস হয়েছে। এই চাঁদা চাওয়া এবং সেই অডিও ফাঁস হওয়ার পুরো ঘটনাকেই সাজানো মনে হচ্ছে। যে খোকন সাহা আইভীর পক্ষে নেই, সেই তিনিই যখন আইভীর নির্বাচনের জন্য চাঁদা চান, তখন খেলাটা বুঝতে কারো অসুবিধা হয় না।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা আইভী-শামীমের দ্বন্দ্ব মেটানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। নানারকম হুমকি-ধামকিও দেয়া হচ্ছে। কিন্তু মনে হচ্ছে তাতে কোনো কাজ হয়নি, হবে তেমন সম্ভাবনাও নেই। দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখার যে ঐতিহ্য আওয়ামী লীগে রয়েছে, নারায়ণগঞ্জে তার ব্যতিক্রম হওয়ার সম্ভাবনা কম। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আনজুম সুলতানা সীমার পরাজয়ের পেছনে বড় হাত ছিল স্থানীয় সাংসদ আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের। কারণ সীমা ছিলেন বাহারের দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী আফজল খানের কন্যা। প্রায় প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে হারানোয় ভূমিকা রাখলেও কুমিল্লায় বাহাউদ্দিন বাহারের সাম্রাজ্যে তার আচর লাগেনি। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করলেও সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পেয়েছেন বাহারই। আর সিটি করপোরেশনে পরাজিত সীমা সংরক্ষিত নারী আসনে সাংসদ হয়েছেন।
২০১১ সালের দিকে একটু ফিরে তাকালে দেখা যায়, দলীয় সিদ্ধান্ত না মেনেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন আইভী। কিন্তু তিনি দলের সিদ্ধান্ত না মেনে ২০১৬ সালে যে নির্বাচন করেছিলেন, সেখানে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার জন্য তাকে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। তবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় দেখা গিয়েছে, আইভি রহমান বিরোধিতা করা সত্ত্বেও দল থেকে মনোনয়ন শামীম ওসমান ঠিকঠাক পেয়ে গেছেন। তার মানে এটা দাঁড়ালো আসল লড়াই হবে নির্বাচনের মাঠে।
ইলেকশনের প্রথমদিকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের কথা উল্লেখ করেছিলাম, তবে দেখা যাচ্ছে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে যেমন নির্বাচন হতো তার থেকে এই নির্বাচন অনেকটা সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ ভাবেই সম্পন্ন হচ্ছে। তবে দেখা যাচ্ছে, এখানেও অনেক স্থানে নৌকার প্রার্থীদের ভরাডুবি হচ্ছে। এবার বলা যাক নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের কথা, এই নির্বাচনে শেষ লড়াইয়ে কে জয়ের মালা পরবে সেটা একমাত্র জনগণই নির্ধারণ করতে পারবে। আর এটাও বলতে পারি, জনগণের ঊর্ধ্বে কোন সরকার নয়। দলীয় পর্যায়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল যাই হোক না কেন, নির্বাচন সুষ্ঠু এবং সম্পূর্ণভাবেই যেন হয়।
লেখনীতে হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ।