সম্প্রতি নির্বাচন সামনে রেখে নিজেদের নানা উন্নয়নের গল্প শুনাচ্ছেন। বিষয়টি তারা এমন ভাবে বুঝানোর চেষ্টা করছেন যে আওয়ামীলীগ সরকারে না থাকলে উন্নয়ন ব্যাহত হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে যারা আগে ক্ষমতায় ছিলেন তারা কিছুই করেননি।হঠাৎ করে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এসে সব উন্নয়ন করে ফেলেছে।বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আসিফ নজরুল হুবহু পাঠকদের জন্য নিচে তুলে ধরা হলো।
বর্তমান সরকার একটা বয়ান প্রায় প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে যে তারা গত ১৪ বছরে দেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটিয়েছে। এর আগে কখনও এমন উন্নয়ন হয়নাই এবং এই সরকার না থাকলে এই উন্নয়ন ধরে রাখা যাবেনা। বয়ানটাকে প্রতিষ্ঠিত বলছি কারণ আমার মনে হয়েছে যে সরকারের কট্টর সমালোচনাকারীরাও এটা সরাসরি চ্যালেন্জ করেননা।
এই পর্যন্ত ঠিক ছিলো। রাজনীতিতে প্রোপাগান্ডা থাকবেই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই প্রোপাগান্ডার উদ্দেশ্য জনগণের অধিকার খর্ব করাকে জায়েজ করা। যেহেতু আওয়ামীলীগ ছাড়া উন্নয়ন হবেনা, তাই ভোটাধিকার, গণতন্ত্র আর মানবিকার পদদলিত করা ঠিক আছে। এই কারণে প্রোপাগান্ডাটা এক্সপোজ করা জরুরি।
“অভূতপূর্ব” উন্নয়ন দেখাতে বর্তমান সরকার বেশ কয়েকটা চালাকির আশ্রয় নেয়। একটা লেখায় এর সবগুলো নিয়ে আলোচনা সম্ভব না। আপাতত উন্নয়নের বহুল ব্যবহৃত সূচক জিডিপি নিয়ে কথা বলা যাক। জিডিপিকে উন্নয়নের মানদন্ড হিসেবে ব্যবহার করায় আরও অনেকের মতো আমারও আপত্তি আছে। কিন্তু আমাদের আলোচনার বিষয় আসলে উন্নয়ন নয়, বরং উন্নয়নবিষয়ক প্রোপাগান্ডা।
সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের আপনি প্রায়ই বলতে শুনবেন যে ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহনের সময় বাংলাদেশের জিডিপি ছিলো ১০২ বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালে সেটা দাঁড়িয়েছে ৪৬০ বিলিয়ন ডলারে। এই পরিসংখ্যানটা শুনলে আসলেই মনে হয় যে অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটে গেছে। তাহলে চালাকিটা কোথায়?
প্রথম চালাকি ১৩ বছর আগের পরিসংখ্যান দেখানো। স্বাভাবিক অবস্থায় সরকারের মেয়াদ হয় ৫ বছর। এক সরকারের সাথে অন্য সরকারের তুলনা করতে গেলে ৫ বছরের টার্ম অথবা বছরপ্রতি পরিসংখ্যান ধরে তুলনা করতে হবে। এখানে ১৪ বছরের অগ্রগতি দেখানোটা কপটতা।
দ্বিতীয় চালাকি জিডিপি বৃদ্ধির হার উল্লেখ না করে মোট জিডিপি দেখানো। ১০০ টাকা ৫% বাড়লে হয় ১০৫ টাকা। ১০৫ টাকা ৫% বাড়লে কিন্তু ১১০ টাকা হয়না, হয় ১১০.২৫ টাকা। চক্রবৃদ্ধির প্রকৃতি এমন যে বৃদ্ধির হার একই থাকলেও বৃদ্ধির পরিমাণ ক্রমেই বাড়তে থাকে।
সরকারের অর্জন তুলনা করতে মোট জিডিপি ব্যবহারের আরেকটা সমস্যা জনসংখ্যা বৃদ্ধি। জনসংখ্যা বাড়লে বিভিন্ন কারণে জিডিপিও বাড়ে। একদম সোজাসাপ্টা যে কারণটা উল্লেখ করা যেতে পারে সেটা হচ্ছে হাউজহোল্ড কনসাম্পশন। মানুষ বাড়লে পরিবারের ব্যয় বাড়ে এবং সেটা গিয়ে জিডিপিতে যোগ হয়।
সবশেষ চালাকিটা হচ্ছে মোট জিডিপিকে কারেন্ট প্রাইসে দেখানো। গতবছর আপনার বেতন যদি ২০,০০০ টাকা হয়ে থাকে এবং এই বছর সেটা বাড়িয়ে ২১,০০০ করা হয় তাহলে আপনার বেতন বাড়লো কত? নমিনাল টার্মে আপনার বেতন ১,০০০ টাকা বেড়েছে। কিন্তু সেই সাথে বেড়েছে জিনিসপত্রের দাম। মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে আপনার বেতন বৃদ্ধি ১,০০০ টাকার চেয়ে কম হবে।
এই সবগুলো চালাকিকে পাশ কাটিয়ে জিডিপির ভিত্তিতে বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারের উন্নয়নের রেকর্ড তুলনা করতে চাইলে আমাদের ব্যবহার করতে হবে কনস্ট্যান্ট প্রাইসে জনপ্রতি জিডিপি বৃদ্ধির হার। সংযুক্ত ছবিতে আপনি সেই চার্ট দেখতে পাচ্ছেন।
২০১৫ সালের প্রাইসকে কনস্ট্যান্ট ধরে নিয়ে এই ডেটা আপনি জাতিসংঘের ডেটাবেইস থেকে নিতে পারবেন (লিংক কমেন্টে)। সহজ কথায় টাকার মূল্য যদি ২০১৫-এর মতো হত, তবে ১৯৯১ থেকে ২০২১ পর্যন্ত প্রতিবছর আগের বছরের তুলনায় জনপ্রতি জিডিপি বৃদ্ধির হার এই চার্টে দেখানো হয়েছে। বেগুনি রঙ বিএনপি এবং কমলা রঙ আওয়ামীলীগের সময়কাল নির্দেশ করে। মাঝখানে একবছর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়টা ধুসর রঙে আছে।
এখানে আপনি গত ১৪ বছরে কোনও অভূতপূর্ব উন্নয়ন দেখতে পাচ্ছেন কি? আমি পেশাগত দক্ষতা আর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যা দেখতে পাচ্ছি সেটা হচ্ছে এই যে ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতা গ্রহনের পর একটা স্থবির অর্থনীতিকে কিকস্টার্ট করে। আওয়ামীলীগ ১৯৯৬ থেকে ২০০২ পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত রাখে। বিএনপির দ্বিতীয় টার্মে বাংলাদেশের অর্থনীতি সত্যিকার অর্থে গতি পায় যেটা বর্তমান সময় পর্যন্ত জারি আছে। মাঝখানে ২০০৮-০৯ এর মন্দা আর ২০২০-২১ এর প্যান্ডেমিকের প্রভাবও ডেটায় দৃশ্যমান।
সবশেষ কথা এই যে আওয়ামীলীগের অভূতপূর্ব উন্নয়নের দাবিটা সত্য হলেও সেটা দিয়ে গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের সংকটকে জাস্টিফাই করা যেত না। আর সেই জায়গায় এই দাবিটাই আসলে ফাঁকি।