আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে নির্বাচন কমিশন বেশকিছু সিদ্ধান্তে রদবদল আনছে। পূর্বের নির্বাচনগুলো থেকে এবার দেশের অনেকগুলো সংসদীয় আসনে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে এবার নিজস্ব কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। যারা নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তা রয়েছেন তাদের পারিবারিক ইতিহাস এবং তাদের পূর্বে কোন রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ছিল কিনা সে বিষয়েও তথ্য সংগ্রহ শুরু হয়। এর আগেরকার নির্বাচনগুলোতে জেলা প্রশাসকেরা রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োজিত করা হতো।
এরই মধ্যে জেলা পরিষদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব থেকে অপসারণ করা হয়েছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক (ডিসি) মমিনুর রহমানকে।
তার পরিবর্তে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মুহাম্মদ হাসানুজ্জামানকে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ অবস্থায় গত শনিবার ডিসি ও এসপিদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের বৈঠকে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। কমিশনার আনিচুর রহমান মাঠ পর্যায়ে কিছু অনিয়মের তথ্য উপস্থাপন করলে ডিসি-এসপিরা প্রতিবাদ করে শোরগোল ফেলেন। একপর্যায়ে কমিশনার কথা বন্ধ করে নিজের আসনে চলে যান।
বর্তমানে ৬১টি জেলায় জেলা পরিষদ নির্বাচন চলছে। এ সময় সরকারি কর্মকর্তারা ইসির অধীনে রয়েছেন। এ অবস্থায় ইসির বৈঠকে ডিসিদের হট্টগোল স্বাভাবিকভাবে দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, মূলত জাতীয় নির্বাচন ও চট্টগ্রামের ঘটনায় কোনো কোনো স্থানে ডিসিদের পরিবর্তে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নির্বাচন কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়ার পরিকল্পনায় আগে থেকেই তৎপর ছিলেন ডিসিরা। ইসির বৈঠকে তা জানা গেছে।
ইসির বৈঠকে উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তা একটি গনমাধ্যমকে বলেন, জাতীয় নির্বাচনে ইসির কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা করার উদ্যোগে ডিসিদের মধ্যে ক্ষো’ভ রয়েছে। ফলে নির্বাচন কমিশনার আনিচুর রহমানের বক্তব্যে জেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রসঙ্গ উঠলেই তারা ক্ষু’ব্ধ হয়ে ওঠেন। এসময় তিনি ডিসি-এসপিদের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ তোলেন। ফলে তারা তোলপাড় শুরু করে।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, জেলা পরিষদ নির্বাচনে ৬১টি জেলার মধ্যে ৬০টি জেলায় রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে রয়েছেন সংশ্লিষ্ট জেলার ডিসিরা। চট্টগ্রামের ডিসির মতো অন্তত ২০ ডিসির বিরুদ্ধে ইসির কাছে নানা অভিযোগ করেছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। কিন্তু অন্য কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ইসি। চট্টগ্রামের ডিসিও তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগকে একটি বিশেষ মহলের অপপ্রচার হিসেবে অভিহিত করে নিজেকে নির্দোষ দাবি করছেন।
চট্টগ্রামে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্বে থাকা আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিবও। মঙ্গলবার তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের দায়িত্ব নিয়ে কমিশনের বিভিন্ন বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদেরও সেই সামর্থ্য রয়েছে। এখন কর্তৃপক্ষের উচিত বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখা।
ইসির বৈঠকে হট্টগোলের দুই দিন আগে নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান বলেন, একটি জেলার একাধিক আসনে একজন ডিসি রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। এবার এক জেলায় একাধিক রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে। এ জন্য জাতীয় নির্বাচনে ইসি কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এর জন্য দক্ষ, অভিজ্ঞ ও সৎ কর্মকর্তা নির্বাচন করা হবে।
ইসি-ডিসিদের মধ্যে আস্থার সংকট
ডিসিদের বিরুদ্ধে কমিশনার আনিসুর রহমানের অভিযোগ নতুন নয় বলে সোমবার একাধিক কমিশনার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। কমিশনার রাশেদা সুলতানা বলেন, ‘ইসি আনিছুর রহমানের কথার প্রসঙ্গ তাদের (ডিসি, এসপি) ভালো লাগেনি, তবে কথাগুলো সত্য, ভিত্তিহীন নয়। তিনি বলেন, “তাদের গোলমাল করা ঠিক হয়নি। এই পরিবেশ সৃষ্টি কোনোভাবেই ঠিক নয়। হয়তো তারা (ডিসি) তার কথা বলার ধরণ নিতে পারেনি। সাময়িকভাবে একটু খারাপ লাগছে। বিব্রত তো বটেই, কারণ ও রকম একটা ঘটনা কে চায়?…..কিন্তু আমার মনে হয় না মন খারাপ করার কোনো কারণ আছে।’
একই বিষয়ে গতকাল প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের বলেন, সামান্য ভুল বোঝাবুঝির কারণে ডিসি-এসপিদের মধ্যে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।
প্রতিটি নির্বাচনে ম্যাজিস্ট্রেটসহ নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য ইসি থেকে তহবিল বরাদ্দ করা হয়। ওই বৈঠকে এ অর্থের সুষ্ঠু বণ্টন নিয়ে মূলত আলোচনা হয়। ইসি ও ডিসিদের মধ্যে আস্থার সংকটের কারণে বিষয়টি সামনে এসেছে।
জানতে চাইলে নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক (ডিসি) দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, নির্বাচনের সময় ইসি যে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করে থাকে অনেক সময় তার চেয়ে বেশি নিয়োগ দিতে হয়। পরে নিযুক্ত অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেটদের জ্বালানি খরচ ইসি থেকে দেওয়া হয় না। এ জন্য বৈঠকে জ্বালানি খরচের বরাদ্দ বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়।
রংপুর ও খুলনা বিভাগের একাধিক ডিসি বলেন, একজন নির্বাচন কমিশনারও মাঠ প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। এতে হতবাক কয়েকজন ডিসি-এসপি প্রতিবাদ করেন। কারণ নির্বাচনের সময় মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দিনরাত কাজ করতে হয়। বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়। এরপর নির্বাচন কমিশন অনিয়মের অভিযোগ করলে তা মেনে নেওয়া যায় না।
জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, একজন নির্বাচন কমিশনারের ডিসি-এসপিদের বৈঠকে এমন কথা বলা ঠিক নয়। যেকোন ডিসির অনিয়ম চিঠির মাধ্যমে রিপোর্ট করা যেতে পারে বা জড়িতদের রিপোর্ট করার প্রয়োজন ছিল। ডিসিরা এভাবে আওয়াজ না করে কথা বললে ভালো হতো।
সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আইনে বলা নেই, জেলা পরিষদ নির্বাচনে শুধু ডিসিদের দায়িত্ব দেওয়া হলো কেন? ইসির কর্মকর্তা ও ডিসি উভয়কেই দায়িত্ব দেওয়া উচিত ছিল। ইসির অনেক যোগ্য কর্মকর্তা আছেন, জাতীয় নির্বাচনেও তাদের দায়িত্ব দেওয়া উচিত। যেহেতু স্বাধীনতার পর থেকে ডিসি নিয়োগ করা হয়েছে, তার মানে এই নয় যে তাদের নিয়োগ দিতে হবে।
সিটিজেন ফর গুড গভর্নেন্স (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, চট্টগ্রামের ঘটনা ডিসিদের ওপর প্রভাব ফেলেছে। ফলে তারা নির্বাচনের সময় বৈঠকে এসে ইসির সঙ্গে বিশৃঙ্খল আচরণ করেন। সরকারি কর্মচারী হয়ে তারা এটা করতে পারে না। ইসি কেন বিব্রত হবে? তারা ব্যবস্থা নেবে। তিনি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ইসি যেকোনো ব্যবস্থা নিতে পারে। তবে এটাকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে কী হবে তার ভবিষ্যদ্বাণী বলা যেতে পারে। ডিসি-এসপিরা নির্বাচনের অনিয়মকে পাত্তা দেন না।
১৭ অক্টোবর জেলা পরিষদ নির্বাচন। এবারের নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করছেন ডিসিরা। সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের দায়িত্বে রয়েছেন। এ পর্যন্ত ২২টি জেলায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন, যাদের সবাই নৌকার প্রার্থী। বাকি জেলাগুলোতে মূলত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যে।
সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের শেষদিকে অর্থাৎ ডিসেম্বরে কিংবা ২০২৪ সালের প্রথম দিকে অর্থাৎ জানুয়ারীতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করবে বলে খসড়া ঘোষণা দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের সামনে এই নির্বাচনকে ঘিরে অনেক চ্যালেঞ্জ থাকবে যেগুলো মোকাবেলা করে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে ইসিকে। সেটা করলেও বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। কারণ ইতিমধ্যে বিএনপি জানিয়েছে দলটি নির্বাচনে অংশ নেবে না, তবে কয়েকটি শর্ত পূরণ হলেই তারা নির্বাচনে আসবে বলে জানায়। নির্বাচন কমিশন সাফ কথা জানিয়ে দিয়েছে যে, নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের আসবে কিনা সেটা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়।