দীর্ঘ দিন ধরে ক্ষমতার বাইরে রয়েছে বাংলাদেশের বহুল আলোচিত ও জনপ্রিয় অন্যতম একটি রাজনৈতিক দল বিএনপি। এই দলটি টানা ৩ মেয়াদে ক্ষমতার বাইরে রয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকায় এই দলটির মধ্যে নানা ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। এবং অনেক নেতাকর্মীরা দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করছে। তবে সম্প্রতি দলটি কঠোর হয়েছে দলের মধ্যে থাকা বিরোধী নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে। দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় শাস্তির মুখে পড়েছে তৈমুর-কামাল। এই প্রসঙ্গে বিস্তারিত উঠে এলো প্রকাশ্যে।
নারায়ণগঞ্জ বিএনপির দুই প্রভাবশালী নেতাকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। তৈমুর আলম খন্দকার ও এটিএম কামালের হঠাৎ বাদ পড়ায় রাজনৈতিক অঙ্গনে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এ সিদ্ধান্তে বিক্ষুব্ধ বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তৈমুর আলম খন্দকার। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আওয়ামী লীগের সেলিনা হায়াৎ আইভীর কাছে ৬৬ হাজারের বেশি ভোটে হেরে যান। এতে বিএনপির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এর আগে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করায় তৈমুরকে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, জেলা আহ্বায়ক ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম থেকে বরখাস্ত করা হয়। এবার তাকে প্রাথমিক সদস্যপদ থেকেও বহিষ্কার করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তৈমুর আলম খন্দকার বলেন, বহিষ্কারের চিঠি এখনো পাইনি। বহিষ্কৃত হলে আলহামদুলিল্লাহ। তৈমুরের সঙ্গে বহিষ্কৃত এটিএম কামাল নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি তৈমুরের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট ছিলেন। তাকেও প্রাথমিক সদস্যসহ সকল স্তর থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তার জায়গায় মহানগরের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আব্দুস সবুর খান সেন্টুকে।
সোমবার দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বহিষ্কারের এ সিদ্ধান্ত হয়। পরে মঙ্গলবার বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত বহিষ্কারের চিঠি তাদের দুজনের কাছে পৌঁছায়।
জানা গেছে, দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর অবস্থানে রয়েছে বিএনপি। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গেলে কাউকে ছাড় না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে হাইকমান্ড। এরই অংশ হিসেবে দুই নেতাকে প্রাথমিক সদস্যসহ সব স্তর থেকে বহিষ্কার করেছে হাইকমান্ড। বহিষ্কারের বিষয়টি নিশ্চিত করে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, দলবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার ও এটিএম কামালকে প্রাথমিক সদস্যসহ সব স্তর থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করা শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ড হিসেবে বিবেচিত হবে। গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত যে কেউ বহিষ্কৃত হবেন। এ বিষয়ে এটিএম কামাল মঙ্গলবার রাতে বলেন, বহিষ্কারের কথা শুনেছি, তবে এখন পর্যন্ত কোনো চিঠি পাইনি। তবে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে শৃঙ্খলাবিরোধী কাজ করেছি- এ কারণে হাইকমান্ড চাইলে আমাকে বহিষ্কার করতে পারে। তবে জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের কর্মী হিসেবে আমি রাজনীতি করতে চাই।
রোববার নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের মেয়র প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী নৌকা প্রতীকে পেয়েছেন ১ লাখ ৫৯ হাজার ৯৭ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার হাতি প্রতীকে পেয়েছেন ৯২ হাজার ৫৬২ ভোট। অর্থাৎ আইভী ৬৬ হাজার ৫৩৫ ভোট পেয়ে তৈমুর আলম খন্দকারকে পরাজিত করেন। বিএনপি সর্বশেষ ২০২০ সালের ১২ নভেম্বর জাতীয় সংসদের ঢাকা-১৮ ও সিরাজগঞ্জ-১ আসনের উপনির্বাচনে অংশ নেয়। এরপর তারা জাতীয় সংসদের কোনো উপনির্বাচন বা স্থানীয় কোনো নির্বাচনে অংশ নেয়নি। দলীয় প্রতীকে সরকার। গত মার্চে সুপ্রিম পলিসি মেকিং ফোরামের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় দলটি। একাধিক নীতিনির্ধারক সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি দলীয় প্রতীক নিয়ে কোনো নির্বাচনে যাবে না এমন সিদ্ধান্ত হলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অনেক পদপ্রার্থী আলাদাভাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। ইউপি নির্বাচনের ক্ষেত্রে যারা দলীয় নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন তাদের বাধা দেওয়া হয়নি। বরং সে ক্ষেত্রে দল থেকে কাউকে বহিষ্কার বা বহিষ্কার না করার নীতিগত সিদ্ধান্ত ছিল। গত মার্চ থেকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দলটির অনেকেই অংশ নেওয়ায় কেউ কেউ জয়ীও হয়েছেন। তবে এখন কেউ পদ থেকে নির্বাচন করতে পারবেন না- এটা দলীয় সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচনে বড় ব্যবধানে হেরে দলের ভাবমূর্তি ও জনপ্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তৈমুর। কারণ সবাই মনে করছেন, বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলেও দলের ছায়া প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন তৈমুর। নীতিনির্ধারকরা আরও বলেন, দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পথে, যা দেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল, অনেক বিশিষ্ট নাগরিকের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি বহির্বিশ্বও বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং সাত সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সব মিলিয়ে সরকার চাপে রয়েছে। তাই এখন কিছু সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে তারা দেশে-বিদেশে বার্তা দিতে চায় যে দলীয় সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়। তবে বিএনপি সেই ফাঁদে পা দেবে না। জাতীয় নির্বাচনের আগে আরও সুষ্ঠু নির্বাচন করার চেষ্টা করবে সরকার। তবে বর্তমান সরকার ও ইসির অধীনে বিএনপি আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। পদে যারা অংশ নেবে তাদের বহিষ্কার করা হবে। এরই অংশ হিসেবে তৈমুর ও কামালকে বহিষ্কার করা হয়।
এদিকে তৈমুরকে নিয়ে এক ধরনের অস্বস্তি রয়েছে নারায়ণগঞ্জ বিএনপিতে। দলের একটি বড় অংশ তার বিরোধিতা করছে। দল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর শুরুতেই ভোটে ঠেলে দেওয়া হয় খান তৈমুরকে। শুধু পালিয়ে যাননি, তৈমুরের পক্ষে মাঠে না নামতে স্থানীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় একটি অংশ। নামলেকে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে বলেও জানানো হয়। কেন্দ্রের এমন কঠোর সিদ্ধান্তের কারণে শুরু থেকেই তৈমুরকে এড়িয়ে যান স্থানীয় অনেক নেতা। এ ছাড়া স্থানীয় রাজনীতিতে তৈমুরবিরোধী একটি বড় অংশ রয়েছে। সিদ্ধিরগঞ্জে বিএনপির প্রভাবশালী নেতা ও সাবেক এমপি গিয়াসউদ্দিন এবং বন্দর নেতা ও সাবেক এমপি আবুল কালাম, অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেনসহ জেলার অনেক নেতা গত নির্বাচনে তৈমুরের সঙ্গে ছিলেন না। বরং তৈমুরের বিরুদ্ধে তারা অভিনয় করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে, যা ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়। কাউন্সিলর পদে গিয়াসউদ্দিন ও আবুল কালামের ছেলে জয়ী হলেও তৈমুর আলম ওই দুই ওয়ার্ডে নওকারের চেয়ে কম ভোট পেয়েছেন। এছাড়া তৈমুর আলম খন্দকারের নির্বাচনী প্রচারণার কৌশল ছিল ভুল। তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপির অনেক নেতাকর্মী। বিশেষ করে নির্বাচনী প্রচারণায় প্রধানমন্ত্রীর আনুকূল্য চেয়েছেন তৈমুর। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং তার চিকিৎসার দাবিকে তার প্রচারণায় গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। দলের হাইকমান্ড ও তৃণমূল বিএনপির একাংশ তার ওপর ক্ষুব্ধ। এসব কারণে দল থেকে বাদ পড়েছেন তিনি।
ইতিমধ্যে জাতীয়তাবাদী বিএনপি দল শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য দলের অনেকে নেতাকর্মীকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে। এমনকি অনিয়মকারী নেতাদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি প্রদান করেছে। এছাড়াও বেশ কয়েক জন অনিয়মকারীদের তালিকা করেছে দলটি। সেই তালিকা মোতাবেক দলের হাইকমান্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করছে সিনিয়র নেতারা। এবং দলের মধ্যে বর্তমান সময়ে থাকা চলমান সকল সংকট নিরসনের জন্য গ্রহন করেছে নানা ধরনের পদক্ষেপ দলটি।