বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলা ভূমি অফিসের অফিস সহকারী ও কম্পিউটার টাইপিস্ট মোজাম্মেল হক বাকের অফিসে বসেই ঘুষ নেয়ার পর সানন্দে টাকা গুনছেন এমন ভিডিওকে কেন্দ্র করে উপজেলাজুড়ে শুরু হয়েছে তোলপাড়। এবং এই ঘটনায় ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন স্থানীয়রা। ১ মিনিট ২৩ সেকেন্ডের ভিডিওটিতে দেখা যায়, ঘুষের টাকা গোনার পর কম হওয়ার কারনে অফিস সহকারী ঐ ব্যক্তির নিকট আরো এক হাজার টাকা দাবি করতে দেখা যায়। সেই সময় টাকা কম দেওয়ার কারনে যিনি কাজের জন্য টাকা দিয়েছেন তাকে অন্য পথ দেখবার জন্য পরামর্শ দিতে দেখা যায়।
ভুক্তভোগী ওই ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশের একটি জনপ্রিয় গনমাধ্যমকে বলেন, মাস দুয়েক আগে অফিস সহকারী মোজাম্মেল হক বাকেরের কাছে দুটি নামজারি করার জন্য যাই। এ সময় তিনি আমার কাছে ৬০০০ টাকা ঘুষ দাবি করেন। তাকে এক হাজার টাকা কম দেওয়ার চেষ্টা করলেও তিনি কাজটি করার জন্য অস্বীকার করেন এবং আরও এক হাজার টাকা দাবি করেন। এই কারনে তিনি অন্য পথ দেখানোর পরামর্শ দেন। পরে তাকে আরও ৫০০ টাকা দিলে তিনি রেজিস্ট্রেশন করে দেন।
তিনি এ সময় আরও দাবি করেন যে, অফিস একটি নামজারির জন্য ১,১৫০ টাকার বিপরীতে ১০-১৫,০০০ টাকাও নিচ্ছে। মানুষ তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছে। ঘুষের ভিডিওর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঘুষ দেওয়ার সময় কারা ভিডিও করছে তা আমি জানি না। তবে ভিডিওটি তাদের বলেও দাবি করেন তিনি।
ঘুসের লেনদেনের ভিডিওর বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি বাকেরগঞ্জ ভূমি অফিসের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক মোজাম্মেল হক বাকের।
এসব বিষয়ে রোব ও সোমবার উপজেলা ভূমি অফিসে গিয়ে আরও চা’ঞ্চল্যকর ঘুসের তথ্য মিলে যুগান্তরের প্রতিবেদকের কাছে। ভূমি অফিসের কানুনগো, নাজির সার্ভেয়ার, তহসিলদার, অফিস সহকারী, পিয়ন সবাই ঘুষ বাণিজ্যের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। নামজারি, মিস কেস, মিস আপিল, সার্ভে রিপোর্ট, চান্দিনা ভিটা, এমপি কেস, খাস জমি বন্দবস্তি, ভিপি খাজনা দাখিলা থেকে শুরু করে সবকিছুতেই ঘুসের কারবার করেন তারা।
অভিযোগে জানা যায়, উপজেলা ভূমি অফিসের কানুনগো মো. নজরুল ইসলাম, নাজির মো. নাসির উদ্দিন, সার্ভেয়ার ফোরকান, অফিস সহকারী বাকের, অফিস সহায়ক (পিওন) রিয়াজুল ইসলাম রিয়াজ মিলে গড়ে তুলছেন এক সিন্ডিকেট। তারা সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা।
অভিযোগ ও অনুসন্ধান বলছে, ওই সিন্ডিকেট বছরে কয়েক কোটি টাকা ঘুস আদায় করেন উপজেলা ভূমি অফিসের সেবা গ্রহীতাদের কাছ থেকে। ঘুস আদায় তাদের কাছে ওপেন সিক্রেট হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকাশ্য তারা ঘুস আদায় করছে। এ দৃশ্য ভূমি অফিসে গেলেই চোখে পড়ে হরহামেশা।
অনুসন্ধান বলছে, গত দুই বছরে ভূমি অফিসে গড়ে ৬ থেকে ৭ হাজার নামজারি করা হয়েছে। প্রতিটি নামজারিতে ডিসিআর খরচ সরকারি ১ হাজার ১৫০ টাকা নির্ধারিত থাকলেও অফিস খরচ বাবদ ৩ হাজার থেকে সর্বনিম্ন ১০ হাজার টাকা করে আদায় করেন ভূমি অফিসের ওই সিন্ডিকেটরা।
এর মধ্যে নাজির মো. নাসির উদ্দিন একাই উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের নামজারির দায়িত্ব নিয়ে অফিসের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে তার কাছ থেকে ৪টি ইউনিয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় অফিস সহকারী বাকেরকে। এতে অভ্যন্তরীণ কোন্দল কমলেও ঘুসের অভিযোগ কমেনি।
চরাদির ইউনিয়নের কাসেম জানান, তহসিলদারসহ সবাইকে খরচ দিয়ে তিনি তার দুটি নামজারি অনুমোদন করেন। কিন্তু ডিসিআরের জন্য গেলে ৬ হাজার টাকা দাবি করায় তিনি আর নামজারি করতে পারেননি।
নিয়ামতি ইউনিয়নের রাম নগরের নজরুল ইসলাম অভিযোগ করেন ১ হাজার ১৫০ টাকার ডিসিআরে ৩ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। একই ভাবে রহমগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. রফিকুল ইসলামকেও ৩ হাজার ২০০ টাকা দিয়ে ডিসিআর নিতে হয়। এর মধ্যে এক তহসিলদারের বাবার সঙ্গে ঘুস নিয়ে অফিসেই বাকবিতণ্ডা ঘটে যা গিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পর্যন্ত গড়ায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপজেলা ভূমি অফিসের এক কর্মচারী ঐ গনমাধ্যমকে বলেন, এ অফিসে নামজারি করার জন্য টাকাও লাগে, আবার ভাঙতে গেলেও টাকা লাগে। টাকা দিলে তবেই একজনের জমি আরেকজনের নামে হবে। নামজারি ভাঙ্গানোতেও (১৫০টি মামলা জমির মালিকের নিকট হতেও টাকা নেবেন। এ অফিসের টেবিল-চেয়ারও টাকা ছাড়া কিছু চেনে না বলেও তিনি স্বীকার করেন।
কানুনগো নজরুল ইসলাম ১৫০টি মামলায় ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা আদায় করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। একইভাবে ১ লাখ পর্যন্ত মামলা পরিচালনা করছেন এমপি বিষয়ক কেসে। এমনকি মোবাইল কলের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে জানানোর জন্য কানুনগো কল প্রতি ২০০-৫০০ টাকা নিয়ে থাকেন। যারা ভুক্তভোগী তারা এই সকল কাজ করাতে গিয়ে ঘুষের কাছে নাজেহাল হচ্ছেন।
তার হয়রানিতে পড়া মহিউদ্দিন নামের এক ব্যক্তি বলেন, আমার পক্ষ থেকে প্রতিবেদন নেওয়ার জন্য কানুনগোকে ১৫০০০ টাকা দেওয়া লেগেছে। প্রকাশ্যে ঘুষ লেনদেনের ভিডিওর বিষয়ে জানতে চাইলে ইজাজুল হক যিনি উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে রয়েছেন তিনি ঐ গনমাধ্যমকে বলেন, এ বিষয়ে আমি অবগত নই, তবে নিশ্চিত হলে খুব শীঘ্র ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মাধবী রায় যিনি বাকেরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি জানান, বিষয়টি তদন্ত করার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।