গত ২৪ ডিসেম্বর (শুক্রবার) ঢাকা থেকে বরগুনাগামী আভিযান-১০-এ ভ’/য়া’বহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে যার কারনে প্রায় অর্ধশতাধিক যাত্রী প্রয়াত হন এবং অনেকে আহ’/ত হন যার মধ্যে বেশিরভাগ এখনও চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এই ঘটনার বিষয়ে লঞ্চটির মালিক যান্ত্রিক ত্রুটি থাকার কথা অস্বীকার করেছেন। ঝালকাঠি জেলার সদর উপজেলাধীন সুগন্ধা নামক নদীর মাঝখানে লঞ্চটিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর শতাধিক লোক প্রয়াত হন এবং অনেকে নিখোঁজ হয়। ঐ লঞ্চটির মালিকের সাথে যোগাযোগ করে দেশের একটি জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যম, সেই সময় জালাল শেখ নামে ডুবে যাওয়া জাহাজের এক মালিক জানিয়েছিলেন, লঞ্চটির তত্ত্বাবধায়ক আনোয়ার তাকে ভোর ৩টার দিকে আগুন লাগার বিষয়টি জানান। ঐ লঞ্চটির মালিক শুধু একজন নন বলে জানা যায়। তবে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের পর একেক মালিক ভিন্ন ধরনের তথ্য দিচ্ছেন বলে জানা গেছে। যান্ত্রিক ত্রুটির বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে জালাল বলেন, লঞ্চটিতে অন্তত ২১টি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ছিল, কিন্তু আগুন এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে যে সেগুলো ব্যবহারের সময় ছিল না।
এদিকে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে অগ্নিকাণ্ডের সময় শামীম আহমেদ নামের এক মালিক এমভি অভিযান-১০ লঞ্চেই ছিলেন। ইঞ্জিনরুমে আগুন ছড়িয়ে পড়তে দেখে অন্য কর্মীদের মতো তিনিও লঞ্চ থেকে নেমে যান। লঞ্চের আরেক মালিক তাঁর ভাই রাসেল আহমেদ অগ্নিকাণ্ডের পর ঘটনাস্থলে গেলেও মালিক হিসেবে পরিচয় দেননি। হ’/তাহ’তদের স্বজনসহ স্থানীয় লোকজন মালিকপক্ষের ওপর ফুঁসে উঠলে তিনি সেখান থেকে ঢাকায় চলে আসেন।
লঞ্চের চার মালিকের মধ্যে গ্রেপ্তার হওয়া তিনজনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য পাওয়া গেছে বলে র্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সূত্রে জানা গেছে। গত বুধবার রাতে সূত্রাপুরের এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে শামীম ও রাসেলকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। এ দুজন গত ২৭ ডিসেম্বর কেরানীগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার হওয়া হামজালালের ভাতিজা। অন্য মালিক তাঁর আরেক ভাতিজা ফেরদৌস হাসান রাব্বি (১৬)। ডিবির যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, ‘শামীম স্বীকার করেন, ঘটনার সময় তিনি লঞ্চে ছিলেন। ইঞ্জিনরুমে আগুন লাগার পর তিনি নেমে যান। অন্য লঞ্চগুলোর চেয়ে তিন ঘণ্টা আগে পৌঁছানোর জন্যই তাঁরা অভিযান-১০ বেপরোয়া চালান। অনুমোদন ছাড়াই ৭২০ হর্স পাওয়ারের দুটি ইঞ্জিন লঞ্চে লাগানো হয় বলে তাঁরা স্বীকার করেন।’
সূত্র জানায়, সবার আগে গন্তব্যে পৌঁছতে ঘটনার দিন হামজালাল সদরঘাটে গিয়ে সুপারভাইজার আনোয়ার ও ভাতিজা শামীমকে লঞ্চটি দ্রুত চালানোর নির্দেশ দেন। লঞ্চে আগুন লাগার পর তাঁদের মধ্যে যোগাযোগ হলেও তাঁরা যাত্রীদের রক্ষায় কোনো পদক্ষেপ নেননি।
জানতে চাইলে ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, শামীম ও রাসেলকে নৌ আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এখন মামলার সাত আ’/সামি কা’রাগারে।
প্রয়াত ও নিখোঁজ যাত্রীদের স্বজনরা অভিযোগ করেন, লঞ্চের মালিকপক্ষকে রেহাই দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে। অন্যতম মালিক হামজালাল গণমাধ্যমে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে না’/শ’কতা বলে সন্দেহ প্রকাশ করেন। তিনি ঘটনার তদন্ত দাবি করে তিনটি চিঠিও দেন। এরপর নৌ আদালতের মামলায় গ্রে’প্তার ও আত্মসমর্পণ শুরু হয়েছে। তাঁরা সব আ’সামিকে রি’/মান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের দাবি জানান।
তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বরগুনা থানায় করা মামলায় তিন মালিককে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে পুলিশ। ঝালকাঠি থানার মামলায়ও তাঁদের গ্রেপ্তার দেখানোর প্রক্রিয়া চলছে।
তদন্ত কর্মকর্তারা বলেন, মেসার্স আল আরাফ অ্যান্ড কম্পানির মালিক হামজালাল ও তাঁর তিন ভাই প্রয়াত আব্দুস সাত্তার বেপারী, প্রয়াত সিদ্দিকুর রহমান ও হাজি বাচ্চু বেপারী। ২৫ বছর ধরে তাঁরা লঞ্চ ব্যবসা করেন। তাঁদের পৈতৃক বাড়ি মুন্সীগঞ্জে। প্রয়াত দুই ভাইয়ের মালিকানায় এখন সন্তানেরা। সবাই পুরান ঢাকার বাংলাবাজারের জয়চন্দ্র ঘোষ লেনে থাকেন। প্রয়াত আব্দুস সাত্তারের ছেলে শামীম ও বাচ্চু বেপারীর ছেলে রাসেল চাচার সঙ্গে ব্যবসা দেখভাল করেন। প্রয়াত সিদ্দিকুরের ছেলে ১৬ বছর বয়সী ফেরদৌস হাসান রাব্বিও নৌ আদালতের মামলায় আসামি।
এডিসি আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘রাব্বির বয়স ১৬ বছর। সে দশম শ্রেণিতে পড়ে। বাবার সূত্রে নাম এলেও সে কোনো বিষয়ে সম্পৃক্ত ছিল না। এ কারণে তাকে গ্রেপ্তারে আমরা অভিযান চালাইনি।’
গতকাল রবিবার লঞ্চের ইনচার্জ চালক মাসুম বিল্লাহ ও দ্বিতীয় চালক আবুল কালাম নৌ আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাঁদের কারাগারে পাঠানো হয়। এর আগে ২৮ ডিসেম্বর ইনচার্জ মাস্টার রিয়াজ সিকদার ও দ্বিতীয় মাস্টার খলিলুর রহমান আত্মসমর্পণ করেন। এখনো সুপারভাইজার আনোয়ার, সুকানি আহসান ও কেরানি কামরুল প’লাতক। তাঁদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঝালকাঠি থানার এসআই নজরুল ইসলাম বলেন, ‘গ্রেপ্তার তিনজনকে মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে বাকিদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। লঞ্চটিকে ঘাট থেকে সরিয়ে রেখে আলামত সংগ্রহ করা হচ্ছে।’
লঞ্চযাত্রীদের স্মারকলিপি : আমাদের ঝালকাঠি প্রতিনিধি জানান, গতকাল নৌপরিবহনে যাত্রীদের সেবার মান বৃদ্ধির জন্য লাইফ জ্যাকেট, ফায়ারবল স্থাপনসহ আট দফা দাবিতে নৌমন্ত্রীর কাছে একটি স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। লঞ্চযাত্রীদের পক্ষ থেকে একটি দল ঝালকাঠির অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. কামাল হোসেনের কাছে স্মারকলিপিটি জমা দেয়।
উল্লেখ্য, এর আগে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান তোফায়েল আহমেদ সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে ইঞ্জিনে কিছু ত্রুটি খুঁজে পেয়েছি এবং ধারণা করছি যে ত্রুটির কারণে আগুন লেগে থাকতে পারে যা পরবর্তীতে লঞ্চে ছড়িয়ে পড়ে খুব কম সময়ের মধ্যে। ঘটনার দুদিন পর রোববার সকালের দিকে বরগুনা সার্কিট হাউসে প্রয়াতদের স্বজন ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য লিপিবদ্ধ করার কাজ শুরু করে কমিটি। এদিকে লঞ্চটি পরিদর্শন শেষে ফায়ার সার্ভিস ডিফেন্স অ্যান্ড রেসকিউ-এর পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান জানিয়েছিলেন, “আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য দূর্ঘটনায় পড়া লঞ্চটিতে পর্যাপ্ত পরিমান অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ছিল না।” তিনি আরও যোগ করে বলেন যে, লঞ্চের কর্মীরা আগুনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়তো ছিলেন না, তিনি আরো জানিয়েছিলেন যে, লঞ্চ মাস্টার এবং তার সহকারীরাই এই ঘটনার বিষয়ে অবহেলা করেছেন।