Wednesday , October 30 2024
Breaking News
Home / opinion / বাংলাদেশি ধনাঢ্য ব্যক্তিদের ‘অবৈধ স্বর্গ’ যখন বেগমপাড়ায়

বাংলাদেশি ধনাঢ্য ব্যক্তিদের ‘অবৈধ স্বর্গ’ যখন বেগমপাড়ায়

কানাডার রাজধানী টরন্টো স্বাভাবিকভাবেই কানাডায় বাংলাদেশি অভিবাসীদের সবচেয়ে জনপ্রিয় গন্তব্য হয়ে উঠেছে। ধারণা করা হচ্ছে টরন্টোতে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের সংখ্যা ইতোমধ্যে পাঁচ লাখ ছাড়িয়েছে।

টরন্টোর ‘বেগমপাড়া’ সাধারণ বাংলাদেশিদের কাছে বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে পাচার করা অর্থ দিয়ে নির্মিত প্রাসাদঘর বাড়ির পাড়া হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত। অনেকেই শুনলে অবাক হবেন যে টরন্টো বা এর আশেপাশের শহরগুলোর কোথাও বেগমপাড়া বলে কোনো নির্দিষ্ট জায়গা নেই। ‘বেগমপাড়া’ শব্দটি নেওয়া হয়েছে একজন ভারতীয় প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতার একটি চলচ্চিত্র বেগমপুরা থেকে।

ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কর্মরত ভারতীয় পেশাদারদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যক বিনিয়োগের বিষয়টি তুলে ধরতে চাঞ্চল্যকর চলচ্চিত্রটি তৈরি করেছেন। যদিও এই উচ্চ বেতনের পেশাদাররা মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করছিলেন, তারা তাদের স্ত্রী এবং সন্তানদের নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে বসবাস করতে আগ্রহী ছিলেন না।

তাই সঞ্চিত অর্থ বিনিয়োগ করে তাঁরা কানাডার অভিবাসন নিয়ে টরন্টোর বিভিন্ন স্থানে এবং এর আশপাশের শহরগুলোয় বাড়িঘর কিনে স্ত্রী ও সন্তানদের আবাসস্থল গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেছিলেন বিংশ শতাব্দীর আশির দশক থেকে। এভাবে গড়ে উঠেছিল ‘বেগমপুরা’গুলো, যেখানে পুরুষ অভিভাবকের পরিবর্তে নারী অভিভাবকেরাই সন্তানদের নিয়ে বসবাস শুরু করেছিলেন।

উন্নত দেশের পরিবেশে সন্তানদের মানুষ করতে এবং আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য বছরের বেশির ভাগ সময় স্বামীর সাহচর্য ছাড়া একাকী জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন এসব নারী। বছরে অন্তত একবার বা দুইবার এই মহিলারা এবং তাদের সন্তানেরা তাদের স্বামী এবং পিতার সঙ্গ পাওয়ার সৌভাগ্য লাভ করতেন, বাকি সময় শিশুরা তাদের মায়ের অভিভাবকত্বে তাদের জীবন কাটায়।

এভাবে খণ্ডিত পরিবারের জীবনযাত্রা নিশ্চয়ই বঞ্চনা ও বেদনাভারাক্রান্তই হওয়ার কথা। তাঁদের এহেন বঞ্চনা, একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতাকে হাইলাইট করার জন্যই বেগমপুরা ফিল্মটি নির্মিত হয়েছিল। চলচ্চিত্রটি ভারতে ও কানাডায় ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। দর্শকদের মধ্যে এসব নারী ও তাঁদের সন্তানদের প্রতি সমবেদনাই উথলে ওঠে চলচ্চিত্রটি দেখার পর।

কিন্তু বাংলাদেশিদের নির্মিত বেগমপাড়ার বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। টরন্টো শহরের বিভিন্ন অভিজাত এলাকা এবং মিসিসাগা, হ্যামিল্টন, গুয়েলফ এবং লেক অন্টারিওর সীমান্তবর্তী শহরতলির ছোট শহরগুলিতে প্রাসাদিক ভবন বা ‘লেকশোর অ্যাপার্টমেন্ট’ ক্রয় করে বাংলাদেশী ধনী ব্যক্তিদের বেগমপাড়া তৈরি করা হয়েছে। এই বাড়ির অধিকাংশের অবস্থান বেগমপাড়া নামে একটি নির্দিষ্ট এলাকা নয়, বা এটি টরন্টো শহরের সীমানার মধ্যেও নয়। এসব বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট কানাডায় বসবাসরত সাধারণ কানাডিয়ান নাগরিক বা বাংলাদেশি অভিবাসীদের সাধ্যের মধ্যে নেই। এগুলোর দাম প্রায় $১ মিলিয়ন (১০ কোটি টাকার সমতুল্য) থেকে $২ থেকে ৩ মিলিয়ন (২০ থেকে৩০ কোটি টাকার সমতুল্য)।

কানাডায় বসবাসকারী এবং কর্মরত বাংলাদেশী অভিবাসীরা সাধারণত কানাডার বন্ধকী ব্যবস্থা ব্যবহার করে $৩০০,০০০ থেকে $৬০০,০০০ মূল্যের বাড়ি কিনতে পারেন। এ জন্য যেসব শর্ত পালন করতে হয়, সেগুলো বেশ সহজ, বিশেষত স্বামী-স্ত্রী উভয়েই চাকরিজীবী হলে ভাড়াবাড়িতে বা অ্যাপার্টমেন্টে থাকার জন্য যে মাসিক ভাড়া গুনতে হয়, তার চেয়েও সহজ শর্তে এবং কম মাসিক মর্টগেজ-কিস্তিতে কানাডায় বাড়ি কিংবা অ্যাপার্টমেন্ট কেনা সম্ভব। তাই বেশির ভাগ বাংলাদেশি অভিবাসী যত দ্রুত সম্ভব বাড়ি কিংবা অ্যাপার্টমেন্ট কেনাকেই অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী ব্যবস্থা বিবেচনা করে থাকেন।

কানাডায় বাংলাদেশি অভিবাসীরা এসব বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্টের মালিক নন। তারা বেগমপাড়ার ধনী বাসিন্দা নয়। সাধারণ এই বাংলাদেশি অভিবাসীরা বরং বেগমপাড়াকে ঘৃণা করে থাকেন। কারণ, পুঁজি পাচারকারী ধনাঢ্য বাংলাদেশিরা টরন্টোর রিয়েল এস্টেটের বাজারে অসহনীয় মূল্যস্ফীতির জন্য দায়ী। এসব ধনাঢ্য মালিক সরাসরি নগদ অর্থে বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট কিনে থাকেন, তাঁরা মর্টগেজ সিস্টেমের সহায়তা নেন না। বেগমপাড়া বাড়ির মালিকদের নগদ অর্থের কারণে এক দশকে টরন্টো শহর এবং আশপাশের শহরগুলিতে বাড়ি এবং অ্যাপার্টমেন্টের দাম দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে গেছে।

ওভারইনভয়েসিং বাংলাদেশের আমদানি বাণিজ্যে একটি সাধারণ অর্থ পাচারের হাতিয়ার, যেখানে আন্ডারইনভয়েসিং হল রপ্তানি বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ পাচারের প্রধান হাতিয়ার। এই পাচারকৃত অর্থের মাধ্যমে বেগমপাড়ায় বাড়ি কেনা হয়। তা ছাড়া রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না এনে বিদেশে বাড়িঘর কেনার পাশাপাশি সাম্প্রতিক কালে হুন্ডি-পদ্ধতিতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের রেমিট্যান্সের অর্থ (বৈদেশিক মুদ্রা) হুন্ডিওয়ালাদের কাছ থেকে কিনে যাঁরা বিদেশে পুঁজি পাচারের সক্ষমতা রাখেন, তাঁরাও কানাডার বেগমপাড়ায় বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট কিনে থাকেন। যে কারণে বেগমপাড়া বাংলাদেশি ধনী ব্যক্তিদের বিদেশে ‘অবৈধ স্বর্গ’ বানানোর প্রতীক হয়ে উঠেছে। বেগমপাড়ার বেগম সাহেবাদের প্রতি কারো কোনো সহানুভূতি নেই। কারণ, অর্থ পাচারের সক্রিয় সহযোগী হিসেবে তারা স্বেচ্ছায় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বিশ্বের নানা দেশে প্রায় ১ কোটি ৪৯ লাখ বাংলাদেশি অভিবাসী বসবাস করছেন বলে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী সংসদে বক্তব্য দিয়েছেন। তাই প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংখ্যা আনুমানিক দেড় কোটি ধরে নেওয়া যেতে পারে। তাঁদের কতজন কর্মরত রয়েছেন, সেটা জানা খুবই কঠিন। তাঁদের মধ্যে মাত্র কয়েক লাখ ‘সপরিবার অভিবাসী’ হিসেবে বিদেশে বসবাস করছেন, যাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে এবং মালয়েশিয়ায় বসবাস করছেন বলে ধারণা করা হয়।

‘পুঁজি পাচার’ নিয়ে আমার গবেষণা ও গবেষণায় আমি এই আনুমানিক দেড় মিলিয়ন বাংলাদেশী অভিবাসীর মধ্যে খুব সামান্য অংশকে সংযুক্ত করতে পেরেছি। এসব অর্থ পাচারকারীর সংখ্যা কয়েক হাজারের বেশি হবে না। দুর্নীতিবাজ আমলা, প্রকৌশলী, গার্মেন্টস কারখানার মালিক, ধনী ব্যবসায়ী বা প্রান্তিক ক্ষুধার্ত রাজনীতিবিদ হিসেবে বাংলাদেশী সমাজের উচ্চ মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তশালী ও ‘এলিট’ অংশে তাঁদের অবস্থান।

অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে তারা দেশ থেকে বিদেশে পাড়ি জমাতে বাধ্য হচ্ছেন তা বলা যাবে না। ‘অভিজাত’ গোষ্ঠীর মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তারা বৃহত্তর সুখ-শান্তির আশায় দেশত্যাগ করছে। তাদের বেশিরভাগের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল তারা ‘কালো টাকার মালিক’, ভাল মানের শহুরে সম্পত্তির মালিক বা শিল্প-ব্যবসায়ের মালিক, যাদের দেশের ব্যাংক ঋণ পাওয়ার ক্ষমতা রাখেন।

পত্রিকার কলামে আমি নিয়মিত তাদের ‘জাতির এক নম্বর শত্রু’ বলে থাকি। তারা যদি বাপ-দাদার কাছ থেকে অর্জিত এদেশের সম্পদ বিক্রি করে বিদেশি নাগরিকত্বের আশায় অভিবাসন প্রক্রিয়ায় যোগ দেয়, তাহলে তাদের ‘জাতির শত্রু’ বলা যৌক্তিক হবে না। অথবা সারা জীবনের বৈধ উপার্জনের মাধ্যমে প্রাপ্ত আয় থেকে প্রাপ্ত সঞ্চয় ও বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত সম্পদ বা সম্পত্তি বিক্রি করে। কেউ অভিবাসনের মাধ্যমে পরবর্তী সময় বিদেশে সপরিবার বসবাসের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করেন, তাঁকেও গালমন্দ করা ঠিক হবে না।

কিন্তু আমার গবেষণা অনুযায়ী, যাদেরকে আমি ‘জাতীয় শত্রু’ বলি তারা দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার অপব্যবহার করে ব্যাংক ঋণ নিয়ে বছরের পর বছর ধরে তা পরিশোধ না করে বিদেশে পাচার করে আসছে। তাঁরা ব্যাংকগুলোর ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ হিসেবে ঋণ লুটপাটকারীর ভূমিকা পালন করছেন। তারা রাজনীতির আড়ালে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট ও বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় অংশীদার।

স্বাধীনতার ৫২ বছর পর, বাংলাদেশের ‘এক নম্বর সমস্যা’, দুর্নীতি ও পুঁজি লুটপাট, অর্থের মালিক হয়ে তাদের অবৈধ অর্থ বিদেশে পাচার করা, কানাডার টরন্টোতে বেগমপাড়া, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া ও মালয়েশিয়ায় ভ্রাতৃত্ববোধকে সেকেন্ড হোমে পরিণত করা।

লেখক: মইনুল ইসলাম

About Nasimul Islam

Check Also

সংবিধানের কমফোর্ট জোনে থেকে আরেক হাসিনা বানানোর পাঁয়তারা: পিনাকী

বাংলাদেশের জনগণ তাদের সার্বভৌম শক্তির সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটাচ্ছে এবং প্রয়োজনে আবারও করবে। সময়ের সাথে সাথে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *