Monday , December 2 2024
Breaking News
Home / National / পাঁচ বছরে অর্থনীতিকে সংকটে ফেলেছেন লোটাস কামাল, ব্যাংক থেকে দেদার বেরিয়ে গেছে জনগণের অর্থ

পাঁচ বছরে অর্থনীতিকে সংকটে ফেলেছেন লোটাস কামাল, ব্যাংক থেকে দেদার বেরিয়ে গেছে জনগণের অর্থ

সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল (লোটাস কামাল) গত পাঁচ বছরে দেশের অর্থনীতিকে ভয়াবহ সংকটে ফেলেছেন। এ সময় তিনি মন্ত্রিত্বেও যাননি, অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলা করাই ছেড়ে দিয়েছেন। সংকট নিরসনে তিনি কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেননি। তিনি এই সময়ে অর্থনৈতিক সংকট চিহ্নিত করতে পারেননি। বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে অর্থমন্ত্রী হিসেবে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। গত পাঁচ বছরে পুরো অর্থনীতিই ব্যর্থতার ইতিহাস। তার আমলে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ভয়াবহভাবে বেড়ে যায়। জনগণের টাকা ব্যাংক থেকে বেরিয়ে গেছে। এমনকি পরিচালকরা যোগসাজশ করে ব্যাংক থেকে অবাধে টাকা হাতিয়ে নেয়। মোস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রী হিসেবে কোনো ব্যবস্থা নেননি।

মোস্তফা কামালের পাঁচ বছরে ডলার সংকট ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ নেয়। মূল্যস্ফীতি 11 বছরের সর্বোচ্চ বেড়েছে। দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। সার্বিক আর্থিক খাতেও বেড়েছে অনিয়ম ও দুর্নীতি। এ সময়ে মানি লন্ডারিং বেড়েছে কয়েকগুণ। লোটাস কামাল কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বাড়াতে উদ্যোক্তাদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেননি। অর্থনৈতিক সংকট সমাধান তো দূরের কথা, তিনি সংকটের কারণগুলোও চিহ্নিত করতে পারেননি।

একদিকে মন্ত্রণালয়ে কাজ না করলেও ব্যক্তিগত ব্যবসা সম্প্রসারণে সময় দেননি। জানা গেছে, মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানির জন্য চিহ্নিত ১০টি সিন্ডিকেটের মধ্যে একটি মোস্তফা কামালের শ্যালক আরিফ হোসেনের। এসিস নামের এই প্রতিষ্ঠানটি মূলত মোস্তফা কামালের নিজস্ব কোম্পানি। এ সময় তিনি পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। আইনি প্রতিবন্ধকতা দূর করতে কাগজে-কলমে নাম লেখা হয়েছে জামাইয়ের। একইভাবে অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি তার স্ত্রী কাশ্মীরি কামাল ও মেয়ে নাফিসা কামালের নামে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি সিন্ডিকেটের জন্য দুটি লাইসেন্স প্রদান করেন। কোম্পানি দুটি হল অরবিটাল ইন্টারন্যাশনাল এবং অরবিটাল এন্টারপ্রাইজ। এর মধ্যে রয়েছে অরবিটাল মেডিকেল সেন্টার ও গুলশান মেডিকেয়ার লিমিটেড। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ড.মইনুল ইসলাম বলেন, তিনি অর্থমন্ত্রী থাকাকালে সব সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়ে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছেন। দেশের আর্থিক খাতে চরম বিশৃঙ্খলার জন্য গত পাঁচ বছরে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা আ হ ম মুস্তফা কামালই দায়ী। মইনুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে ব্যর্থতার কারণে আর্থিক খাতে নজিরবিহীন স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। যেটা বারবার বলছি, গত পাঁচ বছর তিনি অর্থমন্ত্রী ছিলেন। তিনি আসলে এই পদের জন্য যোগ্য ছিলেন না। এটি একটি রঙ পছন্দ ছিল. অর্থনীতিতে তার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তিনি অযোগ্য ছিলেন। তিনিও নিষ্ক্রিয় ছিলেন। নেতৃত্ব দিতে পারেনি। দক্ষতার কোনো প্রমাণ তিনি রেখে যেতে পারেননি। এমনকি নিজের কাজেও মনোযোগী ছিলেন না। দায়িত্ব পালনে কোনো চেষ্টাই করেননি। যার ফলশ্রুতিতে এসব বিপর্যয় ঘটেছে। অফিস ঠিকমতো করতেন না। ফলে দেশের অর্থনীতিতে অনেক গভীর সংকট তৈরি হয়েছে। অর্থমন্ত্রী হিসেবে পুরো দায়িত্ব তার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা। এটি 2014 সাল পর্যন্ত সহনীয় ছিল। 2014 সালের পর প্রথমবারের মতো এটি 50 হাজার 155 কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এ সময়ই তিনি অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। আর অর্থমন্ত্রীর পদ ছাড়ার প্রাক্কালে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা। একইভাবে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে। আর আ হ ম মুস্তফা কামালের পদত্যাগের প্রাক্কালে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে। যা গত ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এই সময়ে অর্থ পাচারের মাত্রাও অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়। ডলারের সরবরাহ ও বাজার ব্যবস্থাপনার অক্ষমতার কারণে দেশে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ডলার সংকট নেমে এসেছে। কর্টল্যান্ডের স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ নিউইয়র্কের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক বিরূপাক্ষ পাল গত 7-2023 সেপ্টেম্বর প্রথম আলোতে একটি নিবন্ধ লিখে তৎকালীন অর্থমন্ত্রীকে সতর্ক করেছিলেন। সেখানে তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী অসাধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন একজন মানুষ। সর্বনিম্ন সময়ে সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অফিস পরিচালনা করুন। তিনি মহাপুরুষ না হলে সরকার তাকে এই জায়গায় রাখত না। তিনি বিশ্বের দীর্ঘতম রেকর্ডকৃত বাজেট বক্তৃতার প্রবর্তক।

তিনি সেখানে আরও লেখেন, গত ৩১ আগস্ট-২০২৩ মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, ‘যাঁরা বলেন, দেশের অর্থনীতি ভালো নেই, তাঁরা অর্থনীতিই বোঝেন না।’ তিনি (অর্থমন্ত্রীর) এহেন ঢালাও মন্তব্য ভয়ংকর ও দুর্বিনীত। নিজে একজন হিসাববিদ হয়ে, অর্থনীতির কোনো ‘একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড’ না থাকা সত্ত্বেও, অর্থনীতির সবকিছু আমাদের মন্ত্রী বুঝে গেছেন। অর্থনীতির উচ্চশিক্ষা নিয়ে যাঁরা স্বীকৃত অর্থনীতিবিদ, তাঁরা যদি রাষ্ট্রীয় স্বার্থে বিশ্লেষণ বা মতামত প্রকাশ করেন তা পছন্দ না হলেই এসব মানুষ অর্থনীতিই বোঝেন না-অর্থমন্ত্রীর এহেন মূল্যায়ন প্রবাসে আমাদের নিয়োগকর্তাদের হাতে পড়লে আমরা যারা অর্থনীতির পেশায় ডাল-ভাত খাই এবং দেশের অর্থনীতি নিয়ে কিঞ্চিৎ কথা বলি বা লেখালেখি করি, তাদের চাকরি থাকবে না। একইভাবে মন্ত্রী থেকে নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের নামে বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়তে পারেন কি না-এ ব্যাপারে টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য আবুল মোমেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের দেশে একটা সংস্কৃতি চালু হয়েছে যে, মন্ত্রীরাই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটান। এতে সাধারণ মানুষের কাছে একটা ভুল মেসেজ যায়। একই সঙ্গে দুর্নীতিবাজ ও অসৎ ব্যক্তিরা উৎসাহিত হন। এটা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে আমাদের দুর্নীতি কমানো সম্ভব নয়।

এদিকে রাজধানীর গুলশানে প্রভাব খাটিয়ে ১৪ তলার অনুমোদন নিয়ে ২০ তলা ভবন গড়ে তুলেছেন মুস্তফা কামাল। ১৪ তলার ওপরের ৬ তলাই বাড়ানো হয়েছে নকশায় ব্যত্যয় ঘটিয়ে। সম্প্রতি রাজধানীর গুলশান ১ নম্বর সার্কেলে গুলশান এভিনিউসংলগ্ন ৫৯ ও ৬০ নম্বর প্লট মিলিয়ে বিশাল ভবন বানিয়েছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। যদিও ২০ তলা ভবনটির ওপরের ৬টি তলাই বাড়ানো হয়েছে নকশায় ব্যত্যয় ঘটিয়ে। ভবন সম্প্রসারণ করার পর এর অনুমোদন চেয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কাছে আবেদন করেছেন সাবেক মন্ত্রীর পক্ষে তাঁর দুই মেয়ে। তবে রাজউক একাধিকবার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলেও আইনি জটিলতার কারণে এখনো অনুমোদন দেয়নি।

রাজউক সূত্রে জানা যায়, গুলশানের এ ভবনটির অনুমোদন পেতে ২০২১ সালের ২৯ ডিসেম্বর রাজউকে আবেদন করেন আ হ ম মুস্তফা কামালের দুই মেয়ে কাশফি কামাল ও নাফিসা কামাল। আবেদনে জরিমানা দিয়ে ১৪ তলার ওপর ৬ তলা ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণের অনুমোদন চাওয়া হয়েছে। এরপর বিষয়টি রাজউকের পাঁচ সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন (বিসি) কমিটিতে তোলা হয়। গত বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি কমিটির এক সভায় বলা হয়, বিদ্যমান প্লটে তিনটি বেসমেন্টসহ ১৪ তলার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তাই বর্তমানে ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণের অনুমোদন পেতে হলে রাজউকের ভূমি শাখার ছাড়পত্র, ফায়ার সার্ভিস অধিদফতরের ছাড়পত্র, প্রকৌশলী ও স্থপতির লে-আউট নকশা, রাজউকের বৃহদায়তন প্রকল্পের অনুমোদন এবং ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণের জন্য কাঠামোগত উপযোগিতার বিষয়ে স্থাপত্য প্রকৌশল অধিদফতরের প্রত্যয়নপত্র নিতে হবে। অথচ তিনি তা নেননি। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. জামালউদ্দিন আহমেদ বলেন, অর্থমন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে দেশের মানুষের যে প্রত্যাশা ছিল, তিনি সেটা পূরণ করতে পারেননি। অসুস্থ ছিলেন, প্রথমবার বাজেট বক্তৃতা দিতে গিয়ে অসুস্থতার কারণে শেষ করতে পারেননি। বিগত সময়ের কয়েকজন অর্থমন্ত্রী ছিলেন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, তারা ভালো কাজ করেছেন। মুস্তফা কামালও চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ছিলেন। দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য কী কাজ তিনি করেছেন, সেটা হয়তো আবুল মাল আবদুল মুহিত, এম সাইফুর রহমান বেঁচে থাকলে ভালো বলতে পারতেন।

About Zahid Hasan

Check Also

যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সেন্টমার্টিন লিজ দেওয়ার বিষয়ে যা জানালেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি গুজব ছড়িয়েছে যে অন্তর্বর্তী সরকার সেন্টমার্টিন দ্বীপকে লিজ দিচ্ছে। তবে প্রধান …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *