আমি ইন্টার্নশিপ শেষ করার পরে যাকে ডাক্তারি করা বলে তা করিনি। বাবা মা ভাই বোন জিজ্ঞাসা করেছে কেন ডাক্তারি করছিনা। কেন আরো পড়াশোনা করছিনা। তাদের নানা কথা বলে এড়িয়ে গেছি। সত্য কথাটা খুবই অল্প কয়জন যাদের আমি বন্ধু বলে মনে করেছি তাদের সাথে শেয়ার করেছিলাম। এখন তাদের মধ্যে অনেকেই দৃশ্যত শত্রু হয়ে উঠেছে। তাই আমার সেই ডাক্তারি না করার কারণ হয়তো কেউই কখনো জানবেনা যদি আমি সেটা বলে না যাই।
ঘটনাটা যাকে বলে লাইফ চেঞ্জিং। এই ঘটনা না জানলে আমাকে কেউই ব্যাখ্যা করতে পারবে না যে কেন আমি কোন কাজটা করি। আজকের পরে থেকে আমাকে বুঝতে আপনাদের কারোই কোন সমস্যা হবেনা।
আমি ডাক্তারি শুরু করেছিলাম খুব সিরিয়াসলি। যারা আমার চিকিৎসা নিয়েছেন আমার হাতে ডায়াগনোসড হয়েছেন তারা জানেন আমার ক্লিনিক্যাল আঈ খুব ভালো। এখনো আমার ডায়াগনোসিস নির্ভুল হয়।
সে এক রাতের কথা, আমার ইন্টার্নশিপ তখন শেষের দিকে। যারা ডাক্তার তারা জানেন, মেডিসিন ওয়ার্ডে প্রায়ই কিছু অল্প বয়সী তরুণী ভর্তি হয় যারা আসলে কোন কারণে হিস্টিরিয়াগ্রস্থের মতো আচরণ করে, মিথ্যা কথা বলে, কোন রোগ না থাকলেও রোগগ্রস্তদের মতো আচরণ করে। তাদের ডায়াগনোসিস লেখা থাকতো এফ ডি বা ফাংশনাল ডিজিজ বা মিথ্যা রোগী। তাদের কেউ কেউ সারারাত চিৎকার করতো। সেই রাতে আমার নাইট ডিউটি। আমি একাই ওয়ার্ড সামলাচ্ছি। এক তরুণী এমন চিৎকার করছে। অন্য রোগীরা ঘুমাতে পারছে না। আমি রোগীর কাছে গিয়ে তার ট্রিটমেন্ট শিটে দেখলাম লেখা এফ ডি মানে ফাংশনাল ডিজিজ। দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। রোগীকে ধমক দিয়ে বললাম, পাইছেন কী সারারাত আপনি চিৎকার করে কাউরে ঘুমাইতে দিচ্ছেন না, আপনার তো কিছুই হয় নাই, হুদাই চিল্লান কেন?
আশ্চর্য ব্যাপার আমার সেই বিশ্রী ধমক খেয়ে রোগীটি একদম চুপ করে গেলো। তার একটু পরে রোগীর দুই চোখের কোনা দিয়ে পানি ঝরতে লাগলো নিঃশব্দে। আমি থমকে গেলাম, মনে হলো আমি মনে হয় মারাত্মক এক ভুল করেছি। তারপর সারারাত রোগীটি আর চিৎকার করেনি।
মনের মধ্যে থেকে সেই খচখচানিটা গেলোনা। পরদিন ছিলো আমার ডে অফ। তারপরদিন গিয়ে দেখলাম রোগীনি নেই। নার্সকে জিজ্ঞাসা করলাম ওই রোগী কোথায়। নার্স বললো, জানেন না? ওর তো ব্রেন ক্যান্সার ধরা পড়েছে। গতকাল রোগীর লোকেরা ঢাকায় নিয়ে গেছে।
আমার মাথায় বজ্রাঘাত হলো। আমি চোখেমুখে অন্ধকার দেখলাম। আমি নিজেকে বললাম আমি কী মানুষ? একজন ব্রেন ক্যান্সারের রোগীর কী ভয়ানক ব্যথা হয় সেটা তো আমি ডাক্তার হয়ে জানি। সেদিন আমি বুঝলাম, আই ডু নট ডিজার্ভ টু বি এ ডক্টর। আমি তখন ঘোরতর নাস্তিক, তাও বললাম, ঈশ্বর যেন আমাকে ঠিক এমন যন্ত্রণার মৃত্যু দেন, আমি যেন ক্যান্সারে মরি এমন যন্ত্রণা পেতে পেতে। সেটা আমার উপযুক্ত পুরষ্কার হবে।
আমি আর ডাক্তারি করার চেষ্টা করিনি। ইন্টার্নশিপের পরে আমার প্রথম চাকরি গ্রামীন ব্যাংকে। আমি অনেক যুক্তি দিতে পারতাম যে যেই ডায়াগোনোসিস লেখা ছিলো সেটা তো আমি লিখিনি আমি বায়াসড হয়েছিলাম, বলতে পারতাম আমি টায়ার্ড ছিলাম, অন্য রোগীরা ঘুমাতে পারছিলোনা। এই ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিলোনা। কিন্তু কোন কিছুই আমাকে বত্রিশ বছর পরেও কনভিন্স করতে পারেনি।
আমি সারা জীবন সেই ডিভাইন শাস্তির প্রতীক্ষা করে যাবো। আমি বিপদে কিঞ্চিৎ বিচলিত হলেও পরক্ষনেই আমি মনে করি সেই শাস্তি মনে হয় সমাগত। একবার আমার মাল্টিওরগ্যান ফেইলিউর হয়েছিলো, একেবারে যমে মানুষে টানাটানি। ডাক্তারেরা আমার ক্যান্সার সন্দেহ করছে। আমি খুব শান্তভাবে সেই সময়টাকে গ্রহণ করেছিলাম। একবার আমার ভোকাল কর্ড প্যারালাইজড হয়ে যায়। আমি কথা বলতে পারিনি অনেকদিন। ডাক্তার বলেছিলো আর আমি কখনো কথা বলতে পারবোনা। আমার আশেপাশের সবাই এই খবরে কান্নাকাটি শুরু করলেও আমি মনে করেছিলাম এটা আমার সেই ডিভাইন শাস্তি। যদিও দিনের পরে দিন স্পিচ থেরাপি দিয়ে আমি গলার স্বর অনেকটা রিকোভার করেছি।
যে শাস্তি পাওয়ার জন্য উন্মুখ, তাকে আপনি কোন জাগতিক শাস্তির ভয় দেখাবেন?
আপানার স্বপ্নে যদি কখনো সেই তরুণী হানা না দেয় যার চোখের দুই কোনা দিয়ে অভিমান, আর কষ্টের মিলিত পানির স্রোত বইছে, আপনি আমাকে বুঝতে পারবেন না। আমি কেন কী করি সেটা বুঝতে পারবেন না। আমার মৃত্যুভয় নেই, রোগের ভয় নেই, জাগতিক কিছু হারানোর ভয় নেই। বরং আমি যন্ত্রণার মৃত্যু কামনা করি, রোগগ্রস্ত হওয়ার আকাঙ্খা করি, আমি আমার ব্যক্তিগত জীবনে কোন কিছু অর্জন করতে চাইনা।
আমার কাছে থেকে এখন কে কী কেড়ে নেবে? আমাকে কে কীসের ভয় দেখাবে?
Home / National / আমি যেন ক্যান্সারে যন্ত্রণা পেতে পেতে মরি, সেটা আমার উপযুক্ত পুরষ্কার হবে : পিনাকী
Check Also
জাহ্নবী কাপুরের ভিডিও ভাইরাল (ভিডিও)
মন্দিরের সিঁড়ির একপাশে অসংখ্য ভাঙা নারিকেল। তার পাশে থেকে হামাগুড়ি দিয়ে উপরে উঠছেন বলিউড অভিনেত্রী …